অজানা কালিকথা


ঈশানী মল্লিক, কলকাতা: তিনি আসছেন….“মা কালী শুধু পূজার মূর্তি নন— তিনি বাংলার প্রতিবাদের মুখ।”
তান্ত্রিক মতে কালী ‘অষ্টধা’ বা ‘অষ্টবিধ’। এই ‘অষ্টধা’ হলেন — দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।
বিভিন্ন অজানা কালিকথা নিয়ে কালী পুজোর প্রাক কালে এই নিবেদন:

কালী তন্ত্রে বলা হয়, “ডাকিন্যো যোগিন্যশ্চ মঙ্গলানী পরায়ণাঃ।” যার অর্থ: ডাকিনী ও যোগিনীরা পরম মঙ্গলকর, তারা যেখানেই থাকেন সেখানেই দেবশক্তির সঞ্চার ঘটে।
তারা সবিনাশ করেন, সাধকের দেহে সত্ত্ববিকাশ ঘটান,
এবং চেতনায় শক্তির উদয় ঘটান। এই কারণে তাদের বলা হয় “শক্তিরক্ষকী” (শক্তিকে রক্ষা ও জাগ্রতকারী দেবতা)
এই সাত ডাকিনী–যোগিনী আসলে আদ্যাশক্তিরই সাত স্তরের রূপ — চেতনার সাত দরজা। যখন সাধক শুদ্ধচিত্তে সাধনা করেন: তারা তার শরীর, মন, প্রাণ ও চেতনার মধ্যে শক্তিপ্রবাহ জাগ্রত করেন; অন্তরস্থ অবিদ্যা ধ্বংস করে জ্ঞান ও ভক্তির সংযোজন ঘটান; সাধকের জীবন থেকে ভয়, বন্ধন, দুঃখ মুছে দেন। অর্থাৎ, ভয়ংকর রূপে উপস্থিত হলেও তারা আসলে করুণাময়ী মঙ্গলদায়িনী মা। ডাকিনী, যোগিনীরা কোনো ভূত বা রাক্ষস নন। তারা আদ্যাশক্তিরই রূপ ভয়ংকর করুণাময়ী মহাশক্তির প্রকাশ। তারা অজ্ঞান বিনাশিনী, জ্ঞানদায়িনী, মঙ্গলপ্রদা। সাধকের চেতনায় তারা জাগ্রত হলে, মানুষ “স্বয়ম্ভু” শক্তিস্বরূপ হয়।
বাংলার সাধক, দর্শন ও সমাজের ভেতরে কালী আজও জীবন্ত শক্তি। তিনি অন্ধকারের মধ্যে আলো, ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টি, মৃত্যুর মধ্যে মুক্তির প্রতীক। তাই তন্ত্রসাধনায় কালী দেবী হলেন—
“আদ্যাশক্তি, মহাকালী, মোক্ষদাত্রী মা।”

(১) ব্রিটিশ শাসনামলে কালীপূজা:
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় (১৭৫৭–১৯৪৭) বাংলায় ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। এ সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ধর্মীয় অভিব্যক্তি ছিল না— এগুলো হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক প্রতিবাদ, সামাজিক ঐক্য ও জাতীয় চেতনার বাহন। সেই প্রেক্ষাপটে কালীপূজা— বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় উৎসব— গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যেখানে দুর্গাপূজা ছিল তুলনামূলকভাবে অভিজাতদের উৎসব, সেখানে কালীপূজা ছিল জনমানুষের, লোকবিশ্বাসের, সংগ্রামী মানসিকতার এক সাংস্কৃতিক প্রকাশ। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কালীপূজা বাংলার স্বাধীনতাকামী সমাজে এক গোপন প্রতিবাদ ও ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই উপনিবেশবাদীরা ভারতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি একদিকে কৌতূহলী, অন্যদিকে অবিশ্বাসী মনোভাব পোষণ করত। অনেক খ্রিস্টান মিশনারি ও ঔপনিবেশিক আধিকারিক হিন্দু ধর্মকে “পৌত্তলিক” বা “অসভ্য” বলে ব্যাখ্যা করত। বিশেষ করে কালী দেবীর রুদ্ররূপ ও শ্মশানসংক্রান্ত তান্ত্রিক আচার ব্রিটিশদের কাছে “ভয়ংকর” ও “অসভ্যতা”র প্রতীক বলে মনে হতো। এই কারণে ঔপনিবেশিক প্রশাসন অনেক সময় কালীপূজা ও তন্ত্রসাধনার উপর সন্দেহ ও নজরদারি চালাত।
কালীপূজা বাংলায় মূলত কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজার মতো অভিজাত জমিদারদের আড়ম্বর ছিল না; বরং কালীপূজা ছিল সাধারণ মানুষের উৎসব। গ্রামের মাঠে, গলির মোড়ে, পাড়ার আঙিনায় বা শ্মশানের পাশে বসত প্যান্ডেল।
এই উৎসবের দুটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—
এক, এটি ছিল রাত্রিকালীন পূজা, যা গোপনে বা আড়ালে সমবেত হওয়ার সুযোগ তৈরি করত। এবং দুই, এটি ছিল লোকসমাজের উৎসব, যা ধর্ম, জাত, শ্রেণি, পেশা ইত্যাদি ভেদাভেদ ভেঙে ঐক্যের আবহ তৈরি করত।
ব্রিটিশ শাসনের সময় এই কালীপূজার মঞ্চেই অনেক সময় জাতীয়তাবাদী বক্তব্য, গোপন বৈঠক ও সংগঠনের কার্যক্রম চলত। বিপ্লবীরা প্রায়শই কালী মন্দিরে গিয়ে শপথ গ্রহণ করতেন। কালীকে তারা শক্তির দেবী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে মানত। কালী মূর্তির সামনে তারা “বন্দে মাতরম” উচ্চারণ করে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জনের প্রতিজ্ঞা করত। তাছাড়া, অনেক অস্ত্রভাণ্ডার ও বিপ্লবীর কেন্দ্র কালীপূজার আসরের আড়ালে গোপনে চালানো হত। দেবীর কালো রূপ, মুণ্ডমালা ও রক্তাক্ত প্রতীক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করার এক মানসিক সাহসের উৎস।
প্রতিমায় কালীকে অনেক সময় অসুরের উপর দাঁড়িয়ে দেখা যেত, আর অসুরকে ইংরেজ সৈন্য বা রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হত। পল্লীগীত, কীর্তন ও নাটকে ইংরেজ শাসনের অত্যাচারকে কালী দেবীর রুদ্ররূপে ধ্বংসের কথা বলা হত। এইভাবে কালীপূজা হয়ে উঠেছিল এক গোপন প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক ভাষা, যা ব্রিটিশ প্রশাসন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
ব্রিটিশ শাসনামলে কালীপূজা শুধুমাত্র একটি পূজা ছিল না— এটি ছিল গোপন প্রতিবাদের ভাষা, মানসিক সাহসের প্রতীক, এবং জনমানুষকে একত্র করার একটি সাংস্কৃতিক উপকরণ।
যেখানে দুর্গা ছিলেন সমাজের শৃঙ্খলিত শক্তির প্রতীক, কালী ছিলেন রুদ্র, প্রতিরোধী ও মুক্তির দেবী। ঠিক সেই রুদ্রশক্তির আড়ালেই জন্ম নিয়েছিল বিপ্লবীদের শপথ, প্রতিরোধের গান, আর স্বাধীনতার স্বপ্ন।
আজও মা কালী বাংলার সংস্কৃতিতে কেবল ভক্তির নয়, প্রতিরোধ ও আত্মসম্মানের এক চিরন্তন প্রতীক।
(২)গোপাল পাঁঠার আধারিত কসাই কালী:
কলকাতার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেবী কালীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শহরটি নিজেই ‘কালীক্ষেত্র’ বা ‘কলিকাতা’ (কালীঘাট থেকে উদ্ভূত একটি নাম, যা থেকে ‘কলকাতা’ নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন) নামে পরিচিত ছিল। প্রধান মন্দিরগুলির বাইরেও, শহরের বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজস্ব ধারায় কালী পূজা করতেন। ‘কসাই কালী’ এই ধারারই এক বিশেষ ঐতিহ্য, যা মূলত শহরের কসাই বা মাংস বিক্রেতাদের দেবীর প্রতি গভীর ভক্তি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংমিশ্রণকে নির্দেশ করে। এটি অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।
‘কসাই কালী’ ধারণাটির উৎপত্তি কলকাতার মাংস ব্যবসা এবং প্রচলিত হিন্দু ধর্মীয় রীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
‘বৃথা মাংস’ তত্ত্ব ও দেবীর ভূমিকা
অষ্টাদশ শতকের বাংলায় একটি প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল যে, কোনো প্রাণীর মাংস যদি দেবীর কাছে উৎসর্গ (বলি) না করা হয়, তবে সেই মাংস হিন্দুরা গ্রহণ করতে পারতেন না। সেটিকে ‘বৃথা মাংস’ (নিষিদ্ধ বা অপবিত্র মাংস) বলে গণ্য করা হতো।
কসাই বা মাংস বিক্রেতারা প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ পশু (প্রধানত পাঁঠা) জবাই করতেন, তার সবটাই কালীঘাট বা অন্য কোনো মন্দিরে বলির জন্য উৎসর্গ করা সম্ভব ছিল না। ফলে, তাদের রুজি-রোজগার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এই ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকল্পে, মাংস বিক্রেতারা (যাদের বসতি একসময় ‘কসাইটোলা’ নামে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এলাকায় ছিল বলে জানা যায়) নিজেদের দোকানের কাছে বা ভেতরে কালীর ছোট মন্দির বা মূর্তি স্থাপন করেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, দেবীর কাছে প্রতীকীভাবে বা মন্ত্রের মাধ্যমে উৎসর্গ করার ফলে জবাই করা পশুটির মাংস ‘প্রসাদী মাংস’ হিসেবে গণ্য হবে এবং তা ‘বৃথা মাংস’ হবে না। এই স্থানীয় দেবীই পরিচিত হন ‘কসাই কালী’ নামে।
বউবাজার এবং চিৎপুর ছিল পুরনো কলকাতার মাংস বিক্রির কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম। এই এলাকাগুলিতেই মাংসের দোকানের আশেপাশে কসাই কালীর ছোট মন্দির বা দেবীর ছবি দেখা যেত। কসাইটোলা এলাকাটি পরে নাম পাল্টে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক কসাইদের বসতি ও পেশাগত প্রয়োজন থেকেই এই আরাধনার জন্ম।
কসাই কালী কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা ছিল না, এর পেছনে ছিল গভীর সামাজিক ও ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি।
পেশাগত পাপমোচন
হিন্দু তন্ত্রমতে, দেবী কালী সংহারের দেবী। তিনি কাল (সময়) ও পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রক। কসাইদের পেশা যেহেতু প্রাণীহত্যা, তাই এই পেশার সঙ্গে জড়িত পাপ বা কর্মফলের (Karma) ভয় তাদের মধ্যে কাজ করত।
কসাইরা বিশ্বাস করতেন যে, দেবী কালীর কাছে বলিদান বা উৎসর্গ করে হত্যা করলে সেই কর্মফল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দেবী স্বয়ং সেই প্রাণীর সংহারের ভার গ্রহণ করেন। দেবী কালী এখানে মোক্ষদাত্রী বা পাপমোচনী রূপে পূজিত হতেন।
এটি একটি ‘প্রফেশনাল সিন অ্যাবসোলিউশন’ বা পেশাগত পাপমুক্তির প্রক্রিয়া, যা কসাইদের ধর্মীয় শান্তি এবং সমাজে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা
কসাই কালী ছিলেন মাংস ব্যবসার অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের প্রতীক। দেবীর আশীর্বাদ ছাড়া মাংস ‘বৃথা মাংস’ বিবেচিত হলে তা কেউ কিনত না, ফলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেত। কসাই কালী নিশ্চিত করতেন যে তাদের ব্যবসা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুমোদন পাচ্ছে। হিন্দু সমাজে কসাইদের পেশা সব সময় উচ্চ স্থান পেত না। কিন্তু দেবীর পূজার মাধ্যমে তারা সমাজের বৃহত্তর ধর্মীয় কাঠামোতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। এটি ছিল প্রান্তিক পেশার মানুষদের নিজেদের অস্তিত্ব ও জীবিকার বৈধতা প্রতিষ্ঠার একটি উপায়।
লোক-ধর্মের প্রকাশ
কসাই কালী ছিলেন কঠোর শাস্ত্রীয় নিয়মের বাইরে গড়ে ওঠা লোক-ধর্মের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ধর্মীয় বিশ্বাস সব সময় মূল স্রোতের মন্দিরকেন্দ্রিক হয় না, এটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে স্থানীয় রূপ ধারণ করে। কসাই কালী ছিল কঠোর তন্ত্র বা বৈদিক রীতির বাইরে, পেশাজীবী মানুষের নিজস্ব প্রয়োজন-ভিত্তিক আরাধনা। অনেক ক্ষেত্রে কালীর বদলে পঞ্চানন্দ ঠাকুরের মতো লোক-দেবতার মূর্তিকেও ‘কসাই কালী’ হিসেবে গণ্য করা হতো, যা লোক-ধর্মের বিস্তারকে নির্দেশ করে।
কলকাতার ‘কসাই কালী’ ঐতিহ্য কেবল একটি স্থানীয় প্রথা নয়, এটি কলকাতার নগর-সভ্যতার এক জটিল ইতিহাসের প্রতিফলন। এটি দেখায় যে কীভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস, অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক রীতিনীতি একত্রিত হয়ে এক অনন্য লোক-ঐতিহ্যের জন্ম দিতে পারে। কসাই কালী ছিলেন সেই সময়কার কসাই সমাজের কাছে একদিকে যেমন পেশাগত পাপের মোচনকারী, তেমনি অন্যদিকে তাদের জীবিকা ও সামাজিক বৈধতার নিশ্চিতকরণ। যদিও বর্তমান আধুনিক সরকারি কসাইখানা (যেমন, ১৮৮৪ সালের পর আইন করে প্রতিষ্ঠিত হয়) এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে এই প্রথার দৃশ্যমানতা কমেছে, তবুও কসাই কালী কলকাতার লোক-ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী বিষয় হয়ে আছেন।
(৩) শ্রী করুণাময়ী মাতা মন্দির, টালিগঞ্জ:
উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশনে নেমে বেহালা চৌরাস্তা বা ঠাকুরপুকুরের দিকে আসতে গেলেই টলি নালার ঠিক পাশেই মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয় তো বটেই, গোটা বেহালা, টালিগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের কাছে জাগ্রত মন্দির বলেই পরিচিত এটি। টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দির।
জনশ্রুতি অনুযায়ী বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। তাঁর এক মাত্র কন্যা করুণাময়ী। মেয়ের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেন না নন্দদুলাল। শোকে পাথর হয়ে যান।
সেই সময়ই তাঁর মেয়ে করুণাময়ী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। একটা কষ্টিপাথর দেখিয়ে জানায় সেই পাথরেই সে তার বাবার কাছে থাকবে। আদি গঙ্গা থেকে তিনি নাকি সেই কষ্টিপাথর পান। মেয়ের স্বপ্ন পাওয়ার পর ১৭৬০ সালে আদি গঙ্গা বা টলি নালার পশ্চিম পাড়ে মন্দির তৈরি করেন নন্দদুলাল।
টালিগঞ্জের এই মন্দিরে কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি করা হয় কালীমূর্তি। নন্দদুলাল কালী সাধক হওয়ায় কালীমূর্তি নির্মাণ করেন। মেয়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে যেহেতু তিনি এই মন্দির তৈরি করেছিলেন তাই প্রতিমার নাম রাখেন মা করুণাময়ী।
এই মন্দিরে দেবী কন্যা রূপে পূজিত হন। কালীপুজোর দিন এখানে আজও কুমারী পুজো হয়। প্রতিমা সেজে ওঠে বেনারসি শাড়ি, গয়না এবং ফুলের সাজে।
কালীপুজোর দিন দেবীকে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, পোলাও, তরকারি, লুচি, ছোলার ডাল সহ ১০ রকমের মাছের পদ। থাকে পায়েস, চাটনি, মিষ্টিও।
(৪) হালিসহরের মা গোলকেশ্বরী অথবা হাফকালী:
এখানের মা কালী স্থানীয়দের কাছে ‘হাফকালী’ নামেই বেশি পরিচিত। মায়ের নিম্নাংশ মাটির নীচে রয়েছে। আর এইরূপেই বছর বছর ধরে মা পূজিতা হয়ে আসছেন। তবে একটা পোষাকি নামও রয়েছে মায়ের “মা গোলকেশ্বরী”।
গোলকেশ্বরী অর্থাৎ গোলাকার রানী আর গোলাকা মানে শ্রীকৃষ্ণের রাজ্যকে বোঝানো হয়েছে। তবে দেবী কালীর এক উগ্র রূপ কেও দেবী গোলকেশ্বরী বলা হয়।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন দুই ভাই শ্রী শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জি ও শ্রী ফণিভূষণ চ্যাটার্জি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের (১৩৬২ বঙ্গাব্দ) অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। মায়ের বিগ্রহ এইরূপ কেন তা নিয়ে দ্বিমত প্রচলিত রয়েছে।
প্রথম মতানুযায়ী, দুই ভাই কে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এর দেবী চট্টেশ্বরীর রূপে, অর্ধেক অংশ মাটির নীচে এবং অর্ধাংশ মাটির উপরে থাকবে ও নীচে সোনা-রূপা-তামার থালা সাজিয়ে শোওয়ানো মহাদেব থাকবে, মায়ের দক্ষিণ চরণ মহাদেবের বুকের উপর এবং বাম চরণ মহাদেবের কোমরের উপর রেখে মাকে নাভি পর্যন্ত বেঁধে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পান মায়ের থেকে।
দ্বিতীয় মতে, এই স্থান আগে ছিল শ্মশান, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করার পরে মায়ের পুজো নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ায় তারা ঠিক করেন মায়ের বিগ্রহ মাটির নীচে শওয়ান দেবেন। সেই মতো কাজ করার পরে দুজনেই একসঙ্গে স্বপ্নে দেখেন মায়ের বিগ্রহ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। মন্দিরে গিয়ে দেখলে দেখেন মায়ের ঊর্ধ্বাংশ মাটির উপরে উঠে এসেছে তবে বহু চেষ্টা করেও মায়ের পুরো বিগ্রহ মাটির উপরে তুলতে পারেননি দুই ভাই। পরে দেবীর কাছ থেকে তাঁকে ওই রূপেই পূজা করার স্বপ্নাদেশ পেয়ে এরকম বিগ্রহ ই প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তারপর থেকে এরকমভাবেই মা পূজিতা হয়ে আসছেন।
হালিসহরের রানী রাসমণি ঘাট থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে একটু ভিতর দিকে অবস্থিত এই মন্দির।
(৫) শ্রী জয়কালী মন্দির, শ্যামবাজার:
এই মন্দিরের অবস্থান শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কাছেই। এই মন্দিরে মা কালীর মৃন্ময়ী বিগ্রহ স্থাপনা করেছিলেন গিরীশ ব্রহ্মচারী নামের এক মাতৃসাধক।আধুনিককালে মায়ের প্রস্তর বিগ্রহ স্থাপন করা হয়।
রাস্তার পাশে,ফুটপাথের উপর লাল রঙের মন্দির। সামনে ছোট নাটমন্দির। গর্ভমন্দিরে মা কালীর প্রতিমা। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। গোল গোল তিনটি চোখ। মাথায় সোনার মুকুট, মুখে সোনার জিহ্বা। বিগ্রহ বস্ত্র ও অলংকারে সুসজ্জিত। এখানে শাড়ি পরানোর ধরনটিও অন্য মন্দিরের থেকে অন্যরকম। ভীষণই আকর্ষণীয় এই মাতৃবিগ্রহ।মায়ের বিগ্রহ ছাড়াও শিবলিঙ্গ, নারায়ণ, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি দেবদেবী রয়েছেন গর্ভগৃহে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়।
কথিত আছে,এখানে হাঁসের ডিম দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।নিত্য আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। কালীপূজার দিন মাকে ফুলের গয়নায় সাজানো হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব এই মন্দিরে এসেছিলেন। বিখ্যাত জমিদার ছাতুবাবু এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন।
(৬) শ্রী শ্রী হাজারহাত কালীমন্দির,শিবপুর,হাওড়া:
এই মন্দিরের অবস্থান হাওড়া জেলার শিবপুর অঞ্চলে, কাসুন্দিয়ার কাছে। এলাকাটি আজ হাজারহাত কালীতলা নামেই পরিচিত। কথিত আছে,বহু বছর পূর্বে, হাওড়ার এই অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে মাতৃসাধনা করতেন তন্ত্রসাধক শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৯১৪ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার দিন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাতৃবিগ্রহের।
রাস্তার ধারে,বাড়ির পাশে সাদামাটা ছোট মন্দির। সামনে লম্বা নাটমন্দির,তার পর গর্ভগৃহ। এখানে মাতৃমূর্তি প্রচলিত কালীমূর্তির মতো একদমই নয়। দেবীর উচ্চতা প্রায় বারো ফুটের মতো উঁচু। গাত্রবর্ণ নীলচে সবুজ। ডান হাতে একটি পঞ্চশূল, বাম হাতে খড়গ। বাকি ৯৯৮ টি হাত পেছনের দেওয়ালে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় প্রোথিত রয়েছে। ডান পায়ের নীচে পদ্ম এবং বাম পায়ের নীচে রয়েছে বাহন সিংহ। দেবী লোলজিহ্বা নন, হাস্যময়ী। তাঁর দন্তপাটি দৃশ্যমান। দেবীর পরনে শাড়ি। সোনা ও রূপার বহুমূল্য অলংকার এবং পুষ্পমাল্য আভরণে বিগ্রহ সুসজ্জিতা।মায়ের চোখ তিনটি গোল গোল,আকর্ষণীয়। মায়ের বিগ্রহ ছাড়াও অনেক দেবদেবীর প্রাচীন পটচিত্র রয়েছে মায়ের মন্দিরে এবং নাটমন্দিরের দেওয়ালে। এছাড়াও বাইরে উঠোনে হনুমানজির ছোট একটি মন্দির রয়েছে।শ্রীশ্রীচণ্ডীর মধ্যম চরিত্রে যে দেবী মহালক্ষ্মীর সহস্রভূজা রূপের কথা আছে, সেই রূপের সঙ্গে মায়ের এই রূপের অনেক মিল।
সারাবছর নিত্য পূজার পাশাপাশি দীপান্বিতা অমাবস্যা, বৈশাখী পূর্ণিমাতে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়।বাঙালিদের পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের ভক্তরাও বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয়রাও এই মন্দিরে আসেন মাতৃদর্শনে।শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় তামিল ভক্তরা মন্দিরে বিশেষ পূজার আয়োজন করেন। হাওড়া থেকে বাসে মন্দিরতলা বা শিবপুর বাজার এসে টোটোয় অনায়াসেই এই মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
(৭) মাকড়চন্ডী মা, হাওড়া:
প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি পুরানো মাকড়চন্ডী মায়ের মন্দির, যা অবস্থিত হাওড়া জেলার ডোমজুর থানার অন্তর্গত মাকড়দহ গ্রামে।
শোনা যায় বহু পূর্বে এই মন্দিরের পিছন দিয়ে নাকি সরস্বতী নদী বয়ে যেত যদিও বর্তমানে তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। সেই সময় শ্রীমন্ত সওদাগর নামে কোন এক সওদাগর সরস্বতী নদীর ওপর দিয়ে বাণিজ্যে যাবার সময়
স্বপ্নদেশ পেয়ে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই সময় পাতাল থেকে ১০ ফুট উচ্চতার এক প্রস্তর খণ্ড পাতাল থেকে উঠে আসে ও সেটা কেই মাতৃ রূপে পূজা করা শুরু হয়। এই ভাবেই বেশ ভালো ভাবে মায়ের পূজা চলছিল, কিন্তু হঠাৎ এক দিন পূজা করতে করতে মন্দিরের পুরোহিত মাকে বলেন -” মা রে তোর উচ্চতা এত বেশি যে আমি তোর ভালো ভাবে সেবাই করতে পারি না, তো মুখ পর্যন্ত আমার হাত পৌঁছয় না রে মা, তুই একটু নিচু হয়ে পরিস নে মা!” এর পরেই মায়ের মূর্তি পাতালে নেমে যেতে থাকে, তখন পূজারী পূজা ছেড়ে মা কে জড়িয়ে ধরে, সেই থেকেই মায়ের মূর্তি এত ছোট।
এরপর কালের চক্রে মন্দির লতা পাতায় ঢেকে যেতে থাকে। অবশেষে ১৭৪৩ সালে জমিদার রামকান্ত কুণ্ডু চৌধুরী এই মন্দির পুনঃনির্মাণ করেন। শোনা যায়, এই জমিদার ছিলেন অন্ধ, কিন্তু মন্দিরের এসে তিনি তাঁর দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান। তাঁর নির্মিত মন্দিরে আজ আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে পেতে বর্তমান মন্দিরে এসে দাঁড়িয়েছে।
মায়ের মূর্তি এখানে শিলাময়ী , সেটা লাল সিঁদুরে রাঙানো ও তাতে স্বর্ণের ত্রিনয়ন, অলংকার ও কান পাসা দিয়ে সাজানো।
প্রতিদিন মায়ের নিত্য পূজা হয় সঙ্গে নিরামিষ ও আমিষ দুই প্রকার ভোগই মাকে নিবেদন করা হয়।
ভোগে থাকে খিচুড়ি, চচ্চড়ি,তরকারি,পাঁচ রকম ভাজা ও আমিষ ভোগে থাকে মাছ, পরমন্ন,চাটনি।
মায়ের বিশেষ পূজা হয় দুর্গা পূজা ও পঞ্চম দোলের দিন।
এই সময় এক মাস ব্যাপি মেলা ও উৎসব চলে।
(৮) শ্মশানকালী:
শ্মশানেশ্বরী কালিকার ধ্যান মন্ত্র এবং কলকাতার বুকে কেওড়াতলা শ্মশানের ভয়ঙ্করী শ্মশান কালী ও কৃষ্ণ কালীর এক স্থানে নিবাসের মাহাত্ম্য কথা অনেকেরই অজানা।
এখানে দেবীকে কাজল বা অঞ্জন পর্বতের মতো গাঢ় কালো বর্ণযুক্তা এবং শ্মশানের নিবাসিনী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর চোখ দুটি রক্তবর্ণ এবং কালো কেশরাশি মুক্ত বা খোলা। তিনি শুষ্ক মাংসের মতো ওনার শরীরের গঠন অর্থাৎ রোগা,অতিভয়ঙ্করী রূপে বিরাজমানা। দেবীর চোখ পিঙ্গল বর্ণ এবং তাঁর বাম হাতে মদ্যে পূর্ণ একটি নরমুণ্ড (কপাল) রয়েছে। অন্যদিকে, তিনি ডান হাতে সদ্য কাটা একটি মস্তক ধারণ করে আছেন, যিনি সদা কল্যাণময়ী শিবা। তাঁর মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে এবং তিনি চামড়া ও মাংস চর্বণ করতে সর্বদা তৎপর। নানা প্রকার অলঙ্কারে তাঁর অঙ্গ সজ্জিত হলেও তিনি দিগম্বরী (নগ্ন), এবং সর্বদা কারণপান করে মত্ত বা বিভোর। এই মন্ত্রে দেবীর সংহারক ও মুক্তিদাত্রী উভয় রূপই প্রকাশিত হয়েছে।
দেবী শ্মশানেশ্বরী সাধারণ গৃহীদের আরাধ্যা নন, তান্ত্রিক, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা, সাধিকা ভৈরবীরা, গুরু দীক্ষা নিয়ে গুরুদেবের কৃপায় কেবল শ্মশান কালীর আরাধনা করতে পারেন। কথিত আছে, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীমা সারদা একবার দেবীর পুজো করেছিলেন। তবে ঠাকুর বলতেন, গৃহস্থ বাড়িতে পুজো তো দূরের কথা, এমনকি শ্মশানকালীর ছবি রাখাও অনুচিত। কারণ, উপযুক্ত তন্ত্রগুরু ব্যতীত এই কালীর উপাসনা অসম্ভবের নামান্তর এবং গৃহের জন্য বিপজ্জনকও বটে।
কেওড়াতলা শ্মশানে এইরকম আবহেই গত ১৫০ বছর ধরে পুজো হয়ে আসছেন মা শ্মশান কালী। এখানে শ্মশান মায়ের রূপ থেকে শুরু করে পুজো সমস্তটাই ব্যতিক্রমী অন্যান্য কালীপুজোর তুলনায়। অন্যান্য জায়গায় আমরা কালী মূর্তির জিভ বেরিয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু কেওড়াতলা শ্মশান কালীর জিভ বেরোনো থাকে না। এখানে মায়ের রূপ খুবই শান্ত এবং স্নিগ্ধ। এই শ্মশান কালীর মূর্তিও বংশ পরম্পরায় একই শিল্পী এবং তাঁর পরিবার করে আসছেন। শিল্পী অরুণ পাল এই শ্মশান কালীর মূর্তি বানানো শুরু করেছিলেন এবং বংশপরম্পরায় তাঁরই পরিবারের লোকজন, বর্তমানে তাঁর স্ত্রী শ্মশান মায়ের মূর্তি বানান। যেমন এখানে একই শিল্পী বংশ পরম্পরায় মায়ের মূর্তি বানিয়ে আসছেন, ঠিক তেমনই শ্মশান কালী মায়ের পুজোও করেন বংশপরম্পরায় একই পুরোহিত। এই শ্মশানেই রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। যেখানে বসে সাধকেরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এছাড়া এই শ্মশানেই বিরাজ করছেন মহাকাল শিব। এছাড়াও এই শ্মশান কালী পুজো হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে। এই পুজোতে সূরা এবং মাংসের ব্যবহার করা হয়। এই পুজোর প্রধান পুরোহিত অরুণ ঠাকুরের কাছ থেকে জেনে নেওয়া গেল কিভাবে শ্মশান মায়ের পুজো হয়। অরুন ঠাকুর জানালেন, ‘ শ্মশান কালীমায়ের পূজা হয় বিরাচার তন্ত্রমতে। এই শ্মশান কালীর পুজোর একটা নিজস্বতা রয়েছে। এখানে যেমন বিরাচার তন্ত্রমতে পুজো করা হয় তেমনই, এই পুজোয় বিশেষ কিছু ক্রিয়া করা হয়, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা নিষেধ। অরুণ ঠাকুরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন শ্মশান কালী মায়ের জিভ অন্যান্য কালী মূর্তির মত বাইরে বেরিয়ে নেই? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, পুরান মতে মা অসুরকুল নিধন করে, শ্মশানে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং সূরা ও মাংস পান করছিলেন। জীবকুল এসে তখন মায়ের আশীর্বাদ নিচ্ছিল। সেই সময় মায়ের যে রূপ ছিল, শান্ত, স্নিগ্ধ, এখানে দেবী শ্মশান কালী মাতা ও সেই রূপেই পূজিত হন। আর সেই সময় যেহেতু মা খাচ্ছিলেন, তাই তাঁর জিভ বাইরে বেরিয়ে থাকে না। তাছাড়াও মা এখানে দ্বিভূজা। মা এখানে মূলত কল্যাণময়ী রূপে পুজিত হন।’ জানা যায়, শ্মশান কালী মায়ের পুজো শেষ হলেই, পুজোর ঘট শ্মশানের ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। কথিত আছে,মায়ের পুজো এত জাগ্রত,যখন শ্মশান মায়ের পুজো শুরু হয়, তখন কোনও না কোনও শব বা কোনও সধবা-র শব অবশ্যই আসে কাঠের শ্মশানে পোড়ানোর জন্য। একদিকে শব পোড়ানো শুরু হয়, আর অন্যদিকে শুরু হয় মায়ের পুজো। এখানে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৫ টা ছাগবলি হয়। পুজো কমিটির তরফ থেকে দুটো ছাগ বলি দেওয়া হয়। আর বাদবাকি মানুষের মনস্কামনা পূরণ হলে তাঁরা শ্মশান মায়ের সামনে ছাগবলি দেন। কথিত আছে , শ্মশান মা জাগ্রত এবং সকলের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। এখানে যে ছাগ বলি হয়, সেই বলির মাংসই রান্না করে মাকে নিবেদন করা হয়। তাছাড়াও প্রায় ৬০০ কিলো চাল-ডালের ভোগ হয় এখানে। পুজো শেষে যা জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বলা হয়, এই পুজো হরিজনদের। চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ডোম। ডোম এবং তাঁদের পরিবার এই পুজোর সমস্ত আয়োজন করে থাকেন। শ্রী শ্রী সাহানগর কেওড়াতলা শ্মশান কালীমাতা পূজা কমিটির সেক্রেটারি উৎপল সাহা জানালেন, এটা হরিজনদের পুজো। আমরা তাঁদের সাহায্য করে থাকি। মায়ের অলৌকিক কৃপায় এখানে আমাদের পুজোর বাজেট নিয়ে কোনদিন চিন্তা করতে হয় না। কিভাবে যেন মায়ের পুজো এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ের এত বিপুল খরচের টাকা ঠিক উঠে আসে।
(৯) কৃষ্ণ কালী মন্দির, কেওড়া তলা মহাশ্মশান:
চতুর্ভুজা দেবীর এক হাতে রয়েছে খড়গ অন্য একটি হাতে রয়েছে চাঁদ মালা। অর্থাৎ একদিকে যেমন তিনি ভয়ংকরী অন্যদিকে তিনি শান্ত সুশীলা। তার সামনের দুটি হাতে আবার রয়েছে কৃষ্ণের মতন বাঁশি। ঠিক যেমনভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার দুই হাতে বাঁশি ধরে থাকতেন। তেমনভাবেই দেবীর এই ভঙ্গিমায় যেন ধরা পড়েছে শ্রীকৃষ্ণ। দেবীর গায়ের রং নীল অর্থাৎ কৃষ্ণ যেমন শ্যাম বর্ণ তেমনভাবেই দেবীর রূপ ফুটে উঠেছে। অথচ দেবীর অগ্র জিহ্বা প্রসারিত। একই অঙ্গে দুইরূপ ধারণ করেছেন তিনি। স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে, মা মহাকালীর ভক্ত আনন্দঋষি প্রায় ১৫০ বছর আগে তীব্র সাধনা বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনে নিযুক্ত হয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনাথানন্দ নামে আরেক ঋষিও এখানে সাধনা করেছিলেন।
কালীঘাটে শক্তিপীঠের কাছাকাছি এমন ভাবেই পুজিত হয়ে থাকেন দেবী কালী। একদিকে কৃষ্ণ অন্যদিকে কালী দুই ভাবেই তাকে পূজন করা হয়। বস্ত্র এবং অলংকারে তিনি সজ্জিত । দেবী যেন বাঁশি বাজাচ্ছেন এখানে। আবার একই সাথে তিনি সংহার কারিণী।
কৃষ্ণ এবং কালিকে একসঙ্গে দর্শন করতে গেলে অবশ্যই যেতে হবে দক্ষিণ কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানের পাশে এই মন্দিরে। কাঠের চুল্লির একেবারে বাঁদিকে রয়েছে এই মন্দির সেখানে একই অঙ্গে বসবাস করছেন কালী এবং কৃষ্ণ।
(১০) ফুল্লোরা মা, বীরভূম:
বীরভূমের লাভপুরে লোকবিশ্বাস অনুসারে, ফুল্লরায় মা সতীর নিচের ঠোঁটটি পড়েছিল। এই মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। সিন্দুরচর্চিত কচ্ছপাকৃতি শিলাখণ্ডই দেবীর প্রতিভূ। এই মন্দিরের পাশে একটি বিরাট পুকুর আছে। কথিত আছে রামের দুর্গাপূজার সময় হনুমান এই পুকুর থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। ফুল্লরা ভারতের ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম। এখানে মায়ের ভৈরব “বিশ্বেশ”।
(১১) ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি:
১৭০৩ খ্রিস্টাব্দ। সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চল তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলের ভেতর এক শ্মশানে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামের এক তন্ত্রসাধক নিজ হস্তে মাটি দিয়ে মাতৃমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সিমিত ক্ষমতায় তিনি মাটির দেওয়াল তুলে, মাথায় তাল পাতার ছাউনি দিয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। যখন যাত্রীরা এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতেন তখন দূর থেকে এই মন্দিরের ঘন্টার ‘ঠন্-ঠন্’ শব্দ শুনতে পেতেন। সেই থেকে লোক মুখে এর নাম হয় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি।
পরে ১৮০৬ সালে, মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করে বর্তমান রূপ দেন ব্যবসায়ী শঙ্কর ঘোষ। মূলমন্দিরের পাশে আটচালা পুষ্পেশ্বর শিব মন্দিরটিও তাঁরই নির্মিত। বর্তমানে তাঁর বংশধররাই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত। এই শঙ্করবাবুর পৌত্র হলেন শ্রীশ্রী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম শিষ্য স্বামী সুবোধানন্দ।
তাঁর সহিত ঠাকুরের বেশ কয়েকবার এই মন্দিরে আগমন ঘটে। তিনি এখানে মা সিদ্বেশ্বরীকে গান শোনানোর পাশাপাশি জনগণের উদ্দেশ্যে অনেক মহৎ বাণী দিয়েছিলেন যা আজও মন্দিরের দেওয়ালে লেখা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘শঙ্করের হৃদয় মাঝে, কালী বিরাজে’।
এই মন্দির ভারতবর্ষের গুটিকয়েক মন্দিরের মধ্যে একটি যেখানে প্রায় প্রতিদিনই আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। শুধুমাত্র দীপান্বিতা অমাবশ্যা ও ফলহারিণী অমাবশ্যায় মাকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। বলা হয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও নাকি মাকে একবার ডাব-চিংরি নিবেদন করেছিলেন এখানে।
(১২) আনন্দময়ী কালী:
গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে খুব কাছেই, অনাথ নাথ দেব বাজারের পিছনের দিকে, একটি দালান আকৃতির মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রাচীরে একটি ফলকে উল্লেখ আছে প্রতিষ্ঠাবর্ষ—বাংলাব্দ ১১২৫ (অর্থাৎ ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং সেখানে “মতিলাল দেব শর্মা” নামে এক ব্যক্তির নাম খোদাই করা আছে।
মন্দিরটি ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রতিটি অমাবস্যায় (যেমন ফলাহারিণী কালীপূজা, দীপান্বিতা কালীপূজা এবং রটন্তী কালীপূজা) বিশেষ পূজা পালিত হয়। আজ থেকে তিন শতাব্দী আগে কলকাতার চেহারা একেবারেই ভিন্ন ছিল। তখন মন্দিরের আশেপাশের এলাকা ছিল ঘন বনাঞ্চল। ঐ সময়ে মিত্ররা ছিলেন এই এলাকার জমিদার।
মতিলাল দেব শর্মা, যিনি বর্তমান সেবায়েত পরিবারের পূর্বপুরুষ, এক রাতে স্বপ্নে এক বিরল দেবীমূর্তি দেখেন। স্বপ্নে তিনি দেখেন, মা কালী শিবের বুকে আসীন। পরদিন তিনি সেই দেবীমূর্তিটি পেয়ে স্থানীয় জমিদারের সহযোগিতায় মন্দিরে প্রতিস্থাপন করেন। এই মূর্তির ভঙ্গিটি সত্যিই অনন্য—যেখানে সাধারণত মা কালীকে শিবের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখানে তিনি শিবের বুকে বসে আছেন। নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যায়, শিবের মাথাটি দেবীর ডানদিকে অবস্থিত। দেবীর ডান পাশে নীলবর্ণের কালভৈরবের একটি মূর্তি রয়েছে, হাতে ত্রিশূল। এই দেবীকে “আনন্দময়ী বসা কালী” নামে লোকমুখে পরিচিত।
প্রতিটি অমাবস্যায় দেবীর উদ্দেশ্যে “অন্নভোগ” নিবেদন করা হয়—যার মধ্যে থাকে লুচি, শোল মাছ, পায়েশ, পাঁচ রকমের ভাজা ও মিষ্টি। এখানে এখনও পশুবলি দেওয়া হয়, যদিও এখন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মূল প্রবেশদ্বারের ডান দিকে বলিদানের স্থানটি দেখা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম আসতেন এই মন্দিরে নিজের রচিত গান শোনাতে মা শ্যামা সুন্দরী কে।
(১৩) ‘ঘোমটা কালী’ , উত্তর কোলকাতার শ্যামপুকুর:
একমাত্র মা কালীর রূপ ঘোমটা কালী। প্রসঙ্গত, এই মন্দিরটি সরকার থেকে হেরিটেজ সম্মানে সম্মানিত।
বলরাম ঘোষ স্ট্রিটে অবস্থিত এই মন্দিরটি আনুমানিক ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে (১২৯৫ বঙ্গাব্দে) বৈশাখ মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। বলরাম ঘোষের বংশের বধূ শ্রীমতী দয়াময়ী দাসী মন্দির তৈরি শুরু করলেও তিনি তা সম্পূর্ণ দেখে যেতে পারেননি তার আগেই পরলোক গমন করেন এবং পরবর্তীতে তার পুত্র সারদাপ্রসাদ ঘোষ সেই কাজ সম্পূর্ণ করেন। মূল গর্ভগৃহ ছাড়াও দু-পাশে রয়েছে দুটি আটচালাবিশিষ্ট শিবমন্দির। শিবমন্দিরে দুটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ হরেশ্বর ও হরপ্রসন্ন নামে পূজিত হন।
মা ভবতারিণীর পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে, অন্নভোগ হয় না। নুন ছাড়া লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, মিষ্টান্ন ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়।
(১৪) মা কিরীটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদ:
কিরীটেশ্বরী। সতীর ৫১ পীঠের একটি। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ কোর্ট রোড রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে যেতে হলে নৌকায় নদী পেরিয়ে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরেই পৌঁছানো যায় এই সতীপীঠে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এখানে সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের কণা পতিত হয়েছিল। অনেকে বলেন, দেবীর কিরীট বা মুকুট সংবলিত কপালের উর্ধ্ব ভাগ পড়েছিল এই স্থানে। সেই থেকেই নাম হয়েছে কিরীটেশ্বরী। এখানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কিরীটেশ্বরী কালী নামে পরিচিত।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই অঞ্চলটি ভারতের সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। শোনা যায়, নবাব মীরজাফর তাঁর মৃত্যুশয্যায় কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মা কিরীটেশ্বরীর পবিত্র চরণামৃত চেয়েছিলেন। সবদিক থেকে বিচার করে তাই এই কিরীটেশ্বরী মন্দির মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীনতম, পবিত্রতম এবং একটি বিখ্যাত ধর্মীয় স্থান যা মুকুটেশ্বরী মন্দির নামেও অনেকের কাছে পরিচিত ।
(১৫) নৈহাটীর ভবতারিণী বড়মা:
“ধর্ম হোক যার যার বড়মা সবার”
জয় বড় মা জয় বড়মা
নৈহাটির অরবিন্দ রোডের ২২ ফুট, চলতি কথায় ১৪ হাতের বড় কালীকে ‘বড় মা’ বলেই ডাকেন। শুধু নৈহাটি নয় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখানকার মা “বড় মা” নামেই পরিচিতা।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করা দরকার যে নৈহাটির সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে প্রাচীন আর সবচেয়ে শ্রদ্ধার কালীপূজা এটি
এতটাই শ্রদ্ধার যে, বড় মা বিসর্জনের আগে শহরের আর কোনও ঠাকুরের বিসর্জনই হয় না। সবার আগে পথ ছেড়ে দেওয়া হয় এই মাকে।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এই পূজার শুভ সূচনা হয়েছিল। ১৯২০ সালে স্বর্গীয় ভবেশ চক্রবর্তী মহাশয়ের বাড়ীর বিপরীতে ক্যাওড়া পাড়ায় প্রতি বছর রক্ষা কালী পূজা হতো। ক্যাওড়ারাই এই পূজার দায়িত্ব পালন করতো। তখন এই মাতৃ প্রতিমার বিগ্রহটি উচ্চতায় ছোটো ছিল।পূজার শেষে মাকে মিষ্টি ও ডাবের জল দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হতো। সেই সময় কোনো অন্নপ্রসাদ নিবেদন করা হতো না।
১৯২৭ সালে ভবেশ চক্রবর্তী ও তার চারজন বন্ধু,তাঁরা হলেন, রাখাল চন্দ্র দে, গদাই মোদক, প্রমথ চক্রবর্ত্তী ও ভদ্রেশ্বর পাত্র। ভাঙ্গা রাস উৎসব উপলক্ষে নবদ্বীপ ধামে যান। পোড়ামা তলার সুউচ্চ মহিষ মর্দ্দিনী দেবীর বিগ্রহ দেখে অভিভূত হন ভবেশ চক্রবর্তী। এরপর আরও উচ্চতা বিশিষ্ট রাধাকৃষ্ণ, কালী, শিব প্রভৃতি দেবদেবীর বিগ্রহ দর্শন করে ধন্য হন তাঁরা।
লোকশ্রুতি মতে, ভবেশ চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নেন নৈহাটির যার পূর্ব নাম নবহট্ট; অরবিন্দ রোডের ভিতরে ক্যাওড়া পাড়াতেই সুউচ্চ কালী বিগ্রহ স্থাপণ করে পূজা করবেন। লক্ষ্মী পূজার আগের দিন তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন গঙ্গার তীরবর্তী ধর্মশালার সন্নিকটে দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার পূণ্য লগ্নে যেন মায়ের পূজা করা হয়। পরের দিন সকালে ব্যারাকপুরের স্বনামধন্য ভাস্কর বিশ্বনাথ পাল মহাশয়কে ভবেশ জানান, সুউচ্চ কালী প্রতিমা নির্মাণের জন্য। তিনি ভবেশ বাবুর কথায় রাজী হন এবং ধর্মশালার সন্নিকটে কালী মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ শুরু করেন। অবশেষে কালী পূজার আগের দিন মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এই কালী বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় ২২ ফুটের ওপর ছিল। মায়ের বিগ্রহ কে রুপোর গহনা, চাঁদ মালা, খড়গ, মুন্ডুমালা ইত্যাদি পরানোর পরে পূজা পাঠ শুরু হয়। সেই সময় খাসবাটি নিবাসী জগমোহন আচার্য এই পূজা করেছিলেন। তারপর খিচুড়ি, অন্ন, তরকারী, পায়েস প্রভৃতি দিয়ে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হল। দুইদিন ধরে এই পূজা করার পরের দিন বিকেলে মায়ের শ্রী বিগ্রহকে বিসর্জনের জন্য কাঁধে চাপিয়ে গঙ্গাবক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় লোকজনের সংখ্যাও তুলনামূকভাবে অনেক কম ছিল সেই জন্য জুট মিলের লোকজন ও কুলীরা এতে অংশগ্রহণ করত। এই ভাবেই মায়ের নিরঞ্জন সুদীর্ঘ ৫০ বছর ধরে একই রীতি অনুসারে পালিত হয়। এরপর ১৯৭০ সাল থেকে মা এর কাঠামোতে চাকা লাগিয়ে রথের ন্যায় দড়ি দিয়ে টেনে গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দেওয়া শুরু হয়। সেই নিয়মই এখনো পর্যন্ত পালন করা হয়ে থাকে। নিয়মের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।
কেন এই বড়ো মায়ের নামকরণ?
১৯২৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই দেবী “ভবেশ কালী” নামে সুপ্রসিদ্ধা ছিল। ২০১২ সালে অমলেশ চক্রবর্তীর দেহত্যাগের পর এই পূজা সার্বজনীন হয়ে যায়।
মা কে সঠিক সময় প্রসাদ না দেওয়া, কোনো রকমে পূজা সমাপ্ত হওয়া এই নিয়ে অনেকেই মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন সেই জন্যই ভবেশ চক্রবর্তীর পরিবার থেকে এই পূজা সার্বজনীন হয়। ২০১২ সালের পর থেকে নৈহাটির মানুষেরা “বড় কালী” নামে আখ্যা দিয়েছেন এই। মাকে। যেহেতু নৈহাটি অঞ্চলের সর্বপ্রাচীন এই পূজা এবং মহা এই দেবী তাই জন্য সকলেই অন্তর থেকে “বড়মা” সম্বোধন করেন।
এবার আসা যাক বড়মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা ও নিত্য পূজাপাঠ সম্বন্ধে:
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রেমচুক মারোয়ারী ধর্মশালা সমাজ বিরোধী কাজের জায়গায় রূপান্তরিত হওয়ার কারণে ২০১৩ সালে “বড়মা কমিটি” সেই স্থানটিকে ঘিরে একটি ছোটো মন্দির তৈরী করে দেন। সেখানেই নিত্য পূজা পাঠ করা হয়। কালীপূজা ছাড়াও ১১ টি অমাবস্যায় মায়ের আরাধনা হয়ে থাকে। কালীপূজার পরে পূর্ণিমার দিনে সত্যনারায়ণ বিগ্রহ নির্মাণ করে পূজা করা হয়ে থেকে।
বড় মায়ের পূজাপর্ব ও দেবী মাহাত্ম্যের বলতে প্রথমেই বলতে হয় লক্ষ্মী পূজার দিন কাঠামো পূজা হয়। তারপরের দিন থেকেই মায়ের বিগ্রহ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায়।
বর্তমানে মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ করেন রাজু বিশ্বাস।
বিগ্রহের উচ্চতা ১৪ হাত বা ২২ ফুট। বড় মায়ের পূজার জন্য কোনো চাঁদা তোলা হয় না। ভক্তদের দান করা অর্থ ও নিবেদিত অলংকারে মা পূজিতা হন। প্রণামী বাক্সে যেমন ভাবে টাকা পয়সা দেয় ভক্তরা ঠিক তেমন ভাবেই সোনা, রূপার অলংকারও দেন। মায়ের বিগ্রহকে সোনার ও রুপোর অলংকারে সুসজ্জিতা করা হয়। সোনার পরিমাণ ১০০ ভরি এবং ২০০ কিলোর কাছাকাছি রুপো। মায়ের পরিধেয় মুকুটটিতে রুপো আছে ৪.৫ কেজি। রুপোর মুন্ডুমালা, কোমরবন্ধনী, খড়গ, শিবের মুকুট, ত্রিশুল, বিল্ব পত্র প্রভৃতি রূপো দ্বারা নির্মিত। মাকে সুসজ্জিত করার পর পূজা পাঠ শুরু হয়।
বর্তমানে বড় মায়ের পূজা করেন সত্যরঞ্জন চক্রবর্তী।
তার হাতেই মায়ের পূজা জাগ্রত হয়েছে। কালী পূজার দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন বড় মা কে দর্শন করতে।
লোকশ্রুতি আছে যে যা মনস্কামনা জানান মায়ের কাছে তাই পূর্ণ করেন এই বড় মা। হাজার হাজার লোক এদিন দন্ডী কাটেন এবং সিক্ত বস্ত্রে মায়ের চরণকমলে মাথা রাখেন।
ভোগ নিবেদনের বিষয়:
যেহেতু পাঁচদিন বড় মা থাকেন, সেই জন্য প্রতিদিন মোট ৫০০০ কেজির ওপর ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন ২০০০ কিলোর ভোগ হয়। পুরোটা রান্না করা হয় গাওয়া ঘি দিয়ে। কোনো তেল ব্যবহার করা হয় না। রাতে বড় মায়ের ভোগে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, লুচি, অন্ন ভোগ, পাঁচ রকম ভাজা(বেগুন, ঢেঁড়স, কুমড়ো, আলু, কাঁচকলা), চাটনি, পায়েস প্রভৃতি।
পূর্বরীতি অনুযায়ী ভবেশ চক্রবর্তী মহাশয় এর বাড়ি থেকে এই ভোগ রন্ধন করে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।
সকালে কুচো ফলের নৈবেদ্য ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় শীতলী প্রসাদে লুচি, লাড্ডু, নাড়ু, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া নিবেদন করা হয়।
তাছাড়া বছরের ১১ টি অমাবস্যায় ৭০০ কেজির উপর ভোগ হয়।
ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যায় ১৭০০ কেজি ভোগ হয়।
বৈশাখ মাসে অন্নকূট উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বড় মায়ের মন্দিরে। পোলাও ভোগ পর্বতসম করে তার উপর ফুল দিয়ে সাজিয়ে নিবেদন করা হয়। সেই প্রসাদ নিতে হাজার হাজার লোক ছুটে আসেন মন্দিরে।
বিসর্জন পর্ব:
মোট চারদিন ধরে হয় পূজা। তারপরের দিন বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের দিন মায়ের এই সকল অলংকার খুলে রাখা হয়। তার পরিবর্তে ২ লক্ষ টাকার ফুলের সাজে সজ্জিতা হন বড়মা। এই সাজেই মা নিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হন। কেবলমাত্র মায়ের ও বাবার স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত ত্রিনয়ন সহ বিসর্জন দেওয়া হয়। মায়ের মুখে পান, মিষ্টি ও জল দিয়ে বরণ করেন কমিটির সম্পাদক।
এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরুষেরাই মায়ের বরণ করে। আর মায়ের মুখে পান পড়ে গেলে মা কে আর আটকানো যাবে না। ঠিক চারটের সময় মায়ের বিগ্রহকে টেনে নিয়ে নৈহাটির গঙ্গা বক্ষে রওনা হয়। এই ভাবে মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
সেবা ও দান – ধ্যান এর মাহাত্ম্য:
বড় মায়ের যজ্ঞে নিবেদন করা কলা খেয়ে অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকী কোনও নিঃসন্তান নারী এই হোমের কলা খেলে সন্তান লাভ করেন বলেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
বড় মায়ের পূজায় যে ফল নিবেদন করা হয় সেই ফল নৈহাটি মাতৃ সদন, ইমামবাড়া প্রভৃতি হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের মধ্যে দান করা হয়।
বড় মায়ের কাছে ৩০-৪০ এর বেশি বেনারসি শাড়ি পূজাতে আসে প্রতি বছর। সেই সমস্ত শাড়ি বিবাহের জন্য দুঃস্থ মহিলাদের দান করে দেওয়া হয়।
এছাড়া কালীপুজার কিছু দিন পর বস্ত্রদান উৎসব করে দরিদ্র মানুষের মধ্যে ভক্তদের নিবেদিত বস্ত্রগুলি বিলিয়ে দেওয়া হয়।
এই ভাবেই আজকে পশ্চিমবঙ্গে বড়ো মায়ের নাম দিকে দিকে প্রচারিত। যে যা মানত করেন বড়মা তার সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ করেন। মা এখানে জ্যান্ত। মায়ের দুই কান খোলা। মা কাউকে খালি হাতে ফেরান না।
(১৬) লেক কালীবাড়ি:
১৯৪৯ সালে তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও মন্দিরটির আরেক নাম “শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির”। প্রথমে মন্দিরটি শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির নামেই পরিচিত ছিল। দক্ষিণ কলিকাতার রবীন্দ্র সরোবর অর্থাৎ ঢাকুরিয়া লেকের বিপরীতে মন্দিরটি অবস্থিত হওয়ায় লেকের পাশ্ববর্তী সার্দান অ্যাভিনিউের এই মন্দিরটি লোক মুখে লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিটির নাম করুণাময়ী মা।
এই কালীবাড়ি ঘিরে নানান কাহিনী ও গল্প শোনা যায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মা কালীর ভক্ত তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি মায়ের সাধনা করতেন। সাধারন মানুষের কাছে তিনি ছিলেন গুরুদেব। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাধনায় খুশী হয়ে মা কালী তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন। তন্ত্রসাধনার উদ্দেশ্যে হরিপদ চক্রবর্তী পাঁচটি নরমুণ্ড দিয়ে একটি ‘পঞ্চমুণ্ডির আসন’ তৈরি করেন। এখনও কালীমূর্তির পাশে এই পঞ্চমুণ্ডির আসন রাখা রয়েছে। মন্দিরের পাশের ঘরে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি রয়েছে। হরিপদ চক্রবর্তী নিজে একজন তান্ত্রিক ছিলেন। মাতৃসাধক হরিপদ চক্রবর্তীর কারণেই কালীমন্দিরের মাহাত্ম্য ক্রমে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিদিন নিত্যপুজো হয়। সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবারও বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। ভক্তদের জন্য প্রতি মঙ্গলবার এবং শনিবার মন্দিরে ১৫ মিনিট অন্তর অঞ্জলি দেওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। পুজোর সময় এখানে সাজ বদল হয় দেবীর। বর্তমানে এখানে করুনাময়ী কালীমাতা ট্রাস্ট নামক একটি ট্রাস্ট বোর্ড রয়েছে, যারা এই কালীবাড়িটি পরিচালনা করেন। লেক কালিবাড়ির উল্টোদিকের সুজ্জিত পার্কে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
মন্দিরের ভিতরে মা বগলা, ধুমাবতী, সন্তোষী মায়ের মূর্তি রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত এই লেক কালীবাড়িতে দক্ষিণা কালীর পুজো হয়। আগামীতে মা শীতলা ও মা মনসা দেবীর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করার কথাও রয়েছে।
লেক কালীবাড়ির সঙ্গে লেক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, কালীবাড়ির রীতি মেনে পুজো শেষে ঘটের বিসর্জন হয় লেকে এবং তারপর লেক থেকেই জল তুলে রাতে আবার মা কালীর পুজো শুরু হয়।
কালী পুজোর দিন সারা রাত ধরে পুজো চলে, অঞ্জলি হয় একদম পুজোর শেষে। অর্থাৎ, অঞ্জলি হতে হতে ভোর হয়ে যায়। লেক কালীবাড়ি প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেকবারই কালীপুজোর দিন মাকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগের তালিকায় থাকে একাধিক রকমের মাছ, খাসির মাংস, পাঁচ রকমের ভাজা, পোলাও, পাঁচমিশালি তরকারি, পায়েস। পুজোর রাতে মা কালীকে এই ভোগ নিবেদন করা হয়। কালী পুজোর দিনে এখানে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। পশু বলি মানত করা নিষিদ্ধ এখানে। কালী পুজোর পরদিন ভোর থেকে মায়ের অন্ন ভোগ সাধারনের জন্য বিতরণ করা হয়।
প্রতি বছর ১৩ই এপ্রিল এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। ১০ই ফেব্রুয়ারি গুরুদেব শ্রী শ্রী হরিপদ চক্রবর্তীর জন্মদিনও পালিত হয় মন্দিরে। এছাড়া গণেশ পুজো, জগদ্ধাত্রী পূজাও বড় করে পালন করা হয়। বর্তমানে মন্দিরটির প্রধান সেবাইত নিতাই চন্দ্র বসু।
(১৭) শ্রী শ্রী শব শিব কালী মন্দির, বারাণসী:
শ্রী শ্রী শব শিব কালী মন্দিরটি বারাণসীর দেওনাথপুরা এলাকার “বাঙালি টোলা” অঞ্চলে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে মন্দিরটি “শব শিব” নামেই বিশেষ পরিচিত।
প্রায় ​২৩০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রাজা মহারাজা শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁর রাজগুরু ছিলেন “শ্রী চন্দ্রশেখর দেব শর্মা”, যিনি একজন মহান ও বিখ্যাত তন্ত্র সাধক ছিলেন। তিনিই ১৭৮৯ সালে এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বলা হয় সাধক চন্দ্রশেখর স্বপ্নে এমন মুর্তি গড়ার আদেশ পেয়েছিলেন স্বয়ং মা কালীর থেকেই।
​এই মন্দিরটি তার অনন্য বিশেষত্বের কারণে ভারত ও বিশ্বের হাজার হাজার ভক্তকে আকর্ষণ করে। দেবীর বিগ্রহ দক্ষিণ দিকে মুখ করে স্থাপিত এবং দেবী পঞ্চমুণ্ডির আসনে (তন্ত্র সাধনায় ব্যবহৃত হয়) উপবিষ্ট। দেবীর বিগ্রহের উত্তরে “অর্ধ শিবলিঙ্গ” অবস্থিত এবং শ্রী মহাকাল ভৈরবের অবস্থানও মা-এর সঙ্গে।
​“শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরি সংস্থিতাং”
​প্রতি অমাবস্যায়, স্থানীয় পুরোহিতরা অধিষ্ঠাত্রী দেবীর উদ্দেশ্যে বলিদান ও অর্ঘ্য নিবেদন করেন। চণ্ডী পাঠ, বগলা পাঠ এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এমনকী, নবরাত্রির সময় বিশেষ অর্ঘ্য নিবেদন, চণ্ডী পাঠ এবং যজ্ঞও নিরলসভাবে চলতে থাকে। এই মন্দিরে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম হয়, যারা মা এর কাছে তাঁদের প্রার্থনা নিবেদন করেন এবং তাঁর আশীর্বাদ চান। তাঁরা প্রতিদিনের আরতিতেও অংশগ্রহণ করেন এবং মায়ের আশীর্বাদের অধীনে তাঁদের জীবন কাটাতে চান।

অজানা কালিকথা


ঈশানী মল্লিক, কলকাতা: তিনি আসছেন….“মা কালী শুধু পূজার মূর্তি নন— তিনি বাংলার প্রতিবাদের মুখ।”
তান্ত্রিক মতে কালী ‘অষ্টধা’ বা ‘অষ্টবিধ’। এই ‘অষ্টধা’ হলেন — দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।
বিভিন্ন অজানা কালিকথা নিয়ে কালী পুজোর প্রাক কালে এই নিবেদন:

কালী তন্ত্রে বলা হয়, “ডাকিন্যো যোগিন্যশ্চ মঙ্গলানী পরায়ণাঃ।” যার অর্থ: ডাকিনী ও যোগিনীরা পরম মঙ্গলকর, তারা যেখানেই থাকেন সেখানেই দেবশক্তির সঞ্চার ঘটে।
তারা সবিনাশ করেন, সাধকের দেহে সত্ত্ববিকাশ ঘটান,
এবং চেতনায় শক্তির উদয় ঘটান। এই কারণে তাদের বলা হয় “শক্তিরক্ষকী” (শক্তিকে রক্ষা ও জাগ্রতকারী দেবতা)
এই সাত ডাকিনী–যোগিনী আসলে আদ্যাশক্তিরই সাত স্তরের রূপ — চেতনার সাত দরজা। যখন সাধক শুদ্ধচিত্তে সাধনা করেন: তারা তার শরীর, মন, প্রাণ ও চেতনার মধ্যে শক্তিপ্রবাহ জাগ্রত করেন; অন্তরস্থ অবিদ্যা ধ্বংস করে জ্ঞান ও ভক্তির সংযোজন ঘটান; সাধকের জীবন থেকে ভয়, বন্ধন, দুঃখ মুছে দেন। অর্থাৎ, ভয়ংকর রূপে উপস্থিত হলেও তারা আসলে করুণাময়ী মঙ্গলদায়িনী মা। ডাকিনী, যোগিনীরা কোনো ভূত বা রাক্ষস নন। তারা আদ্যাশক্তিরই রূপ ভয়ংকর করুণাময়ী মহাশক্তির প্রকাশ। তারা অজ্ঞান বিনাশিনী, জ্ঞানদায়িনী, মঙ্গলপ্রদা। সাধকের চেতনায় তারা জাগ্রত হলে, মানুষ “স্বয়ম্ভু” শক্তিস্বরূপ হয়।
বাংলার সাধক, দর্শন ও সমাজের ভেতরে কালী আজও জীবন্ত শক্তি। তিনি অন্ধকারের মধ্যে আলো, ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টি, মৃত্যুর মধ্যে মুক্তির প্রতীক। তাই তন্ত্রসাধনায় কালী দেবী হলেন—
“আদ্যাশক্তি, মহাকালী, মোক্ষদাত্রী মা।”

(১) ব্রিটিশ শাসনামলে কালীপূজা:
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় (১৭৫৭–১৯৪৭) বাংলায় ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। এ সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ধর্মীয় অভিব্যক্তি ছিল না— এগুলো হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক প্রতিবাদ, সামাজিক ঐক্য ও জাতীয় চেতনার বাহন। সেই প্রেক্ষাপটে কালীপূজা— বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় উৎসব— গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যেখানে দুর্গাপূজা ছিল তুলনামূলকভাবে অভিজাতদের উৎসব, সেখানে কালীপূজা ছিল জনমানুষের, লোকবিশ্বাসের, সংগ্রামী মানসিকতার এক সাংস্কৃতিক প্রকাশ। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কালীপূজা বাংলার স্বাধীনতাকামী সমাজে এক গোপন প্রতিবাদ ও ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই উপনিবেশবাদীরা ভারতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি একদিকে কৌতূহলী, অন্যদিকে অবিশ্বাসী মনোভাব পোষণ করত। অনেক খ্রিস্টান মিশনারি ও ঔপনিবেশিক আধিকারিক হিন্দু ধর্মকে “পৌত্তলিক” বা “অসভ্য” বলে ব্যাখ্যা করত। বিশেষ করে কালী দেবীর রুদ্ররূপ ও শ্মশানসংক্রান্ত তান্ত্রিক আচার ব্রিটিশদের কাছে “ভয়ংকর” ও “অসভ্যতা”র প্রতীক বলে মনে হতো। এই কারণে ঔপনিবেশিক প্রশাসন অনেক সময় কালীপূজা ও তন্ত্রসাধনার উপর সন্দেহ ও নজরদারি চালাত।
কালীপূজা বাংলায় মূলত কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজার মতো অভিজাত জমিদারদের আড়ম্বর ছিল না; বরং কালীপূজা ছিল সাধারণ মানুষের উৎসব। গ্রামের মাঠে, গলির মোড়ে, পাড়ার আঙিনায় বা শ্মশানের পাশে বসত প্যান্ডেল।
এই উৎসবের দুটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—
এক, এটি ছিল রাত্রিকালীন পূজা, যা গোপনে বা আড়ালে সমবেত হওয়ার সুযোগ তৈরি করত। এবং দুই, এটি ছিল লোকসমাজের উৎসব, যা ধর্ম, জাত, শ্রেণি, পেশা ইত্যাদি ভেদাভেদ ভেঙে ঐক্যের আবহ তৈরি করত।
ব্রিটিশ শাসনের সময় এই কালীপূজার মঞ্চেই অনেক সময় জাতীয়তাবাদী বক্তব্য, গোপন বৈঠক ও সংগঠনের কার্যক্রম চলত। বিপ্লবীরা প্রায়শই কালী মন্দিরে গিয়ে শপথ গ্রহণ করতেন। কালীকে তারা শক্তির দেবী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে মানত। কালী মূর্তির সামনে তারা “বন্দে মাতরম” উচ্চারণ করে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জনের প্রতিজ্ঞা করত। তাছাড়া, অনেক অস্ত্রভাণ্ডার ও বিপ্লবীর কেন্দ্র কালীপূজার আসরের আড়ালে গোপনে চালানো হত। দেবীর কালো রূপ, মুণ্ডমালা ও রক্তাক্ত প্রতীক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করার এক মানসিক সাহসের উৎস।
প্রতিমায় কালীকে অনেক সময় অসুরের উপর দাঁড়িয়ে দেখা যেত, আর অসুরকে ইংরেজ সৈন্য বা রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হত। পল্লীগীত, কীর্তন ও নাটকে ইংরেজ শাসনের অত্যাচারকে কালী দেবীর রুদ্ররূপে ধ্বংসের কথা বলা হত। এইভাবে কালীপূজা হয়ে উঠেছিল এক গোপন প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক ভাষা, যা ব্রিটিশ প্রশাসন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
ব্রিটিশ শাসনামলে কালীপূজা শুধুমাত্র একটি পূজা ছিল না— এটি ছিল গোপন প্রতিবাদের ভাষা, মানসিক সাহসের প্রতীক, এবং জনমানুষকে একত্র করার একটি সাংস্কৃতিক উপকরণ।
যেখানে দুর্গা ছিলেন সমাজের শৃঙ্খলিত শক্তির প্রতীক, কালী ছিলেন রুদ্র, প্রতিরোধী ও মুক্তির দেবী। ঠিক সেই রুদ্রশক্তির আড়ালেই জন্ম নিয়েছিল বিপ্লবীদের শপথ, প্রতিরোধের গান, আর স্বাধীনতার স্বপ্ন।
আজও মা কালী বাংলার সংস্কৃতিতে কেবল ভক্তির নয়, প্রতিরোধ ও আত্মসম্মানের এক চিরন্তন প্রতীক।
(২)গোপাল পাঁঠার আধারিত কসাই কালী:
কলকাতার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেবী কালীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শহরটি নিজেই ‘কালীক্ষেত্র’ বা ‘কলিকাতা’ (কালীঘাট থেকে উদ্ভূত একটি নাম, যা থেকে ‘কলকাতা’ নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন) নামে পরিচিত ছিল। প্রধান মন্দিরগুলির বাইরেও, শহরের বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজস্ব ধারায় কালী পূজা করতেন। ‘কসাই কালী’ এই ধারারই এক বিশেষ ঐতিহ্য, যা মূলত শহরের কসাই বা মাংস বিক্রেতাদের দেবীর প্রতি গভীর ভক্তি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংমিশ্রণকে নির্দেশ করে। এটি অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।
‘কসাই কালী’ ধারণাটির উৎপত্তি কলকাতার মাংস ব্যবসা এবং প্রচলিত হিন্দু ধর্মীয় রীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
‘বৃথা মাংস’ তত্ত্ব ও দেবীর ভূমিকা
অষ্টাদশ শতকের বাংলায় একটি প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল যে, কোনো প্রাণীর মাংস যদি দেবীর কাছে উৎসর্গ (বলি) না করা হয়, তবে সেই মাংস হিন্দুরা গ্রহণ করতে পারতেন না। সেটিকে ‘বৃথা মাংস’ (নিষিদ্ধ বা অপবিত্র মাংস) বলে গণ্য করা হতো।
কসাই বা মাংস বিক্রেতারা প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ পশু (প্রধানত পাঁঠা) জবাই করতেন, তার সবটাই কালীঘাট বা অন্য কোনো মন্দিরে বলির জন্য উৎসর্গ করা সম্ভব ছিল না। ফলে, তাদের রুজি-রোজগার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এই ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকল্পে, মাংস বিক্রেতারা (যাদের বসতি একসময় ‘কসাইটোলা’ নামে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এলাকায় ছিল বলে জানা যায়) নিজেদের দোকানের কাছে বা ভেতরে কালীর ছোট মন্দির বা মূর্তি স্থাপন করেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, দেবীর কাছে প্রতীকীভাবে বা মন্ত্রের মাধ্যমে উৎসর্গ করার ফলে জবাই করা পশুটির মাংস ‘প্রসাদী মাংস’ হিসেবে গণ্য হবে এবং তা ‘বৃথা মাংস’ হবে না। এই স্থানীয় দেবীই পরিচিত হন ‘কসাই কালী’ নামে।
বউবাজার এবং চিৎপুর ছিল পুরনো কলকাতার মাংস বিক্রির কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম। এই এলাকাগুলিতেই মাংসের দোকানের আশেপাশে কসাই কালীর ছোট মন্দির বা দেবীর ছবি দেখা যেত। কসাইটোলা এলাকাটি পরে নাম পাল্টে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক কসাইদের বসতি ও পেশাগত প্রয়োজন থেকেই এই আরাধনার জন্ম।
কসাই কালী কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা ছিল না, এর পেছনে ছিল গভীর সামাজিক ও ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি।
পেশাগত পাপমোচন
হিন্দু তন্ত্রমতে, দেবী কালী সংহারের দেবী। তিনি কাল (সময়) ও পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রক। কসাইদের পেশা যেহেতু প্রাণীহত্যা, তাই এই পেশার সঙ্গে জড়িত পাপ বা কর্মফলের (Karma) ভয় তাদের মধ্যে কাজ করত।
কসাইরা বিশ্বাস করতেন যে, দেবী কালীর কাছে বলিদান বা উৎসর্গ করে হত্যা করলে সেই কর্মফল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দেবী স্বয়ং সেই প্রাণীর সংহারের ভার গ্রহণ করেন। দেবী কালী এখানে মোক্ষদাত্রী বা পাপমোচনী রূপে পূজিত হতেন।
এটি একটি ‘প্রফেশনাল সিন অ্যাবসোলিউশন’ বা পেশাগত পাপমুক্তির প্রক্রিয়া, যা কসাইদের ধর্মীয় শান্তি এবং সমাজে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা
কসাই কালী ছিলেন মাংস ব্যবসার অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের প্রতীক। দেবীর আশীর্বাদ ছাড়া মাংস ‘বৃথা মাংস’ বিবেচিত হলে তা কেউ কিনত না, ফলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেত। কসাই কালী নিশ্চিত করতেন যে তাদের ব্যবসা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুমোদন পাচ্ছে। হিন্দু সমাজে কসাইদের পেশা সব সময় উচ্চ স্থান পেত না। কিন্তু দেবীর পূজার মাধ্যমে তারা সমাজের বৃহত্তর ধর্মীয় কাঠামোতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। এটি ছিল প্রান্তিক পেশার মানুষদের নিজেদের অস্তিত্ব ও জীবিকার বৈধতা প্রতিষ্ঠার একটি উপায়।
লোক-ধর্মের প্রকাশ
কসাই কালী ছিলেন কঠোর শাস্ত্রীয় নিয়মের বাইরে গড়ে ওঠা লোক-ধর্মের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ধর্মীয় বিশ্বাস সব সময় মূল স্রোতের মন্দিরকেন্দ্রিক হয় না, এটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে স্থানীয় রূপ ধারণ করে। কসাই কালী ছিল কঠোর তন্ত্র বা বৈদিক রীতির বাইরে, পেশাজীবী মানুষের নিজস্ব প্রয়োজন-ভিত্তিক আরাধনা। অনেক ক্ষেত্রে কালীর বদলে পঞ্চানন্দ ঠাকুরের মতো লোক-দেবতার মূর্তিকেও ‘কসাই কালী’ হিসেবে গণ্য করা হতো, যা লোক-ধর্মের বিস্তারকে নির্দেশ করে।
কলকাতার ‘কসাই কালী’ ঐতিহ্য কেবল একটি স্থানীয় প্রথা নয়, এটি কলকাতার নগর-সভ্যতার এক জটিল ইতিহাসের প্রতিফলন। এটি দেখায় যে কীভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস, অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক রীতিনীতি একত্রিত হয়ে এক অনন্য লোক-ঐতিহ্যের জন্ম দিতে পারে। কসাই কালী ছিলেন সেই সময়কার কসাই সমাজের কাছে একদিকে যেমন পেশাগত পাপের মোচনকারী, তেমনি অন্যদিকে তাদের জীবিকা ও সামাজিক বৈধতার নিশ্চিতকরণ। যদিও বর্তমান আধুনিক সরকারি কসাইখানা (যেমন, ১৮৮৪ সালের পর আইন করে প্রতিষ্ঠিত হয়) এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে এই প্রথার দৃশ্যমানতা কমেছে, তবুও কসাই কালী কলকাতার লোক-ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী বিষয় হয়ে আছেন।
(৩) শ্রী করুণাময়ী মাতা মন্দির, টালিগঞ্জ:
উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশনে নেমে বেহালা চৌরাস্তা বা ঠাকুরপুকুরের দিকে আসতে গেলেই টলি নালার ঠিক পাশেই মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয় তো বটেই, গোটা বেহালা, টালিগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের কাছে জাগ্রত মন্দির বলেই পরিচিত এটি। টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দির।
জনশ্রুতি অনুযায়ী বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। তাঁর এক মাত্র কন্যা করুণাময়ী। মেয়ের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেন না নন্দদুলাল। শোকে পাথর হয়ে যান।
সেই সময়ই তাঁর মেয়ে করুণাময়ী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। একটা কষ্টিপাথর দেখিয়ে জানায় সেই পাথরেই সে তার বাবার কাছে থাকবে। আদি গঙ্গা থেকে তিনি নাকি সেই কষ্টিপাথর পান। মেয়ের স্বপ্ন পাওয়ার পর ১৭৬০ সালে আদি গঙ্গা বা টলি নালার পশ্চিম পাড়ে মন্দির তৈরি করেন নন্দদুলাল।
টালিগঞ্জের এই মন্দিরে কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি করা হয় কালীমূর্তি। নন্দদুলাল কালী সাধক হওয়ায় কালীমূর্তি নির্মাণ করেন। মেয়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে যেহেতু তিনি এই মন্দির তৈরি করেছিলেন তাই প্রতিমার নাম রাখেন মা করুণাময়ী।
এই মন্দিরে দেবী কন্যা রূপে পূজিত হন। কালীপুজোর দিন এখানে আজও কুমারী পুজো হয়। প্রতিমা সেজে ওঠে বেনারসি শাড়ি, গয়না এবং ফুলের সাজে।
কালীপুজোর দিন দেবীকে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, পোলাও, তরকারি, লুচি, ছোলার ডাল সহ ১০ রকমের মাছের পদ। থাকে পায়েস, চাটনি, মিষ্টিও।
(৪) হালিসহরের মা গোলকেশ্বরী অথবা হাফকালী:
এখানের মা কালী স্থানীয়দের কাছে ‘হাফকালী’ নামেই বেশি পরিচিত। মায়ের নিম্নাংশ মাটির নীচে রয়েছে। আর এইরূপেই বছর বছর ধরে মা পূজিতা হয়ে আসছেন। তবে একটা পোষাকি নামও রয়েছে মায়ের “মা গোলকেশ্বরী”।
গোলকেশ্বরী অর্থাৎ গোলাকার রানী আর গোলাকা মানে শ্রীকৃষ্ণের রাজ্যকে বোঝানো হয়েছে। তবে দেবী কালীর এক উগ্র রূপ কেও দেবী গোলকেশ্বরী বলা হয়।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন দুই ভাই শ্রী শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জি ও শ্রী ফণিভূষণ চ্যাটার্জি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের (১৩৬২ বঙ্গাব্দ) অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। মায়ের বিগ্রহ এইরূপ কেন তা নিয়ে দ্বিমত প্রচলিত রয়েছে।
প্রথম মতানুযায়ী, দুই ভাই কে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এর দেবী চট্টেশ্বরীর রূপে, অর্ধেক অংশ মাটির নীচে এবং অর্ধাংশ মাটির উপরে থাকবে ও নীচে সোনা-রূপা-তামার থালা সাজিয়ে শোওয়ানো মহাদেব থাকবে, মায়ের দক্ষিণ চরণ মহাদেবের বুকের উপর এবং বাম চরণ মহাদেবের কোমরের উপর রেখে মাকে নাভি পর্যন্ত বেঁধে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পান মায়ের থেকে।
দ্বিতীয় মতে, এই স্থান আগে ছিল শ্মশান, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করার পরে মায়ের পুজো নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ায় তারা ঠিক করেন মায়ের বিগ্রহ মাটির নীচে শওয়ান দেবেন। সেই মতো কাজ করার পরে দুজনেই একসঙ্গে স্বপ্নে দেখেন মায়ের বিগ্রহ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। মন্দিরে গিয়ে দেখলে দেখেন মায়ের ঊর্ধ্বাংশ মাটির উপরে উঠে এসেছে তবে বহু চেষ্টা করেও মায়ের পুরো বিগ্রহ মাটির উপরে তুলতে পারেননি দুই ভাই। পরে দেবীর কাছ থেকে তাঁকে ওই রূপেই পূজা করার স্বপ্নাদেশ পেয়ে এরকম বিগ্রহ ই প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তারপর থেকে এরকমভাবেই মা পূজিতা হয়ে আসছেন।
হালিসহরের রানী রাসমণি ঘাট থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে একটু ভিতর দিকে অবস্থিত এই মন্দির।
(৫) শ্রী জয়কালী মন্দির, শ্যামবাজার:
এই মন্দিরের অবস্থান শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কাছেই। এই মন্দিরে মা কালীর মৃন্ময়ী বিগ্রহ স্থাপনা করেছিলেন গিরীশ ব্রহ্মচারী নামের এক মাতৃসাধক।আধুনিককালে মায়ের প্রস্তর বিগ্রহ স্থাপন করা হয়।
রাস্তার পাশে,ফুটপাথের উপর লাল রঙের মন্দির। সামনে ছোট নাটমন্দির। গর্ভমন্দিরে মা কালীর প্রতিমা। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। গোল গোল তিনটি চোখ। মাথায় সোনার মুকুট, মুখে সোনার জিহ্বা। বিগ্রহ বস্ত্র ও অলংকারে সুসজ্জিত। এখানে শাড়ি পরানোর ধরনটিও অন্য মন্দিরের থেকে অন্যরকম। ভীষণই আকর্ষণীয় এই মাতৃবিগ্রহ।মায়ের বিগ্রহ ছাড়াও শিবলিঙ্গ, নারায়ণ, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি দেবদেবী রয়েছেন গর্ভগৃহে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়।
কথিত আছে,এখানে হাঁসের ডিম দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।নিত্য আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। কালীপূজার দিন মাকে ফুলের গয়নায় সাজানো হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব এই মন্দিরে এসেছিলেন। বিখ্যাত জমিদার ছাতুবাবু এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন।
(৬) শ্রী শ্রী হাজারহাত কালীমন্দির,শিবপুর,হাওড়া:
এই মন্দিরের অবস্থান হাওড়া জেলার শিবপুর অঞ্চলে, কাসুন্দিয়ার কাছে। এলাকাটি আজ হাজারহাত কালীতলা নামেই পরিচিত। কথিত আছে,বহু বছর পূর্বে, হাওড়ার এই অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে মাতৃসাধনা করতেন তন্ত্রসাধক শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৯১৪ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার দিন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাতৃবিগ্রহের।
রাস্তার ধারে,বাড়ির পাশে সাদামাটা ছোট মন্দির। সামনে লম্বা নাটমন্দির,তার পর গর্ভগৃহ। এখানে মাতৃমূর্তি প্রচলিত কালীমূর্তির মতো একদমই নয়। দেবীর উচ্চতা প্রায় বারো ফুটের মতো উঁচু। গাত্রবর্ণ নীলচে সবুজ। ডান হাতে একটি পঞ্চশূল, বাম হাতে খড়গ। বাকি ৯৯৮ টি হাত পেছনের দেওয়ালে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় প্রোথিত রয়েছে। ডান পায়ের নীচে পদ্ম এবং বাম পায়ের নীচে রয়েছে বাহন সিংহ। দেবী লোলজিহ্বা নন, হাস্যময়ী। তাঁর দন্তপাটি দৃশ্যমান। দেবীর পরনে শাড়ি। সোনা ও রূপার বহুমূল্য অলংকার এবং পুষ্পমাল্য আভরণে বিগ্রহ সুসজ্জিতা।মায়ের চোখ তিনটি গোল গোল,আকর্ষণীয়। মায়ের বিগ্রহ ছাড়াও অনেক দেবদেবীর প্রাচীন পটচিত্র রয়েছে মায়ের মন্দিরে এবং নাটমন্দিরের দেওয়ালে। এছাড়াও বাইরে উঠোনে হনুমানজির ছোট একটি মন্দির রয়েছে।শ্রীশ্রীচণ্ডীর মধ্যম চরিত্রে যে দেবী মহালক্ষ্মীর সহস্রভূজা রূপের কথা আছে, সেই রূপের সঙ্গে মায়ের এই রূপের অনেক মিল।
সারাবছর নিত্য পূজার পাশাপাশি দীপান্বিতা অমাবস্যা, বৈশাখী পূর্ণিমাতে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়।বাঙালিদের পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের ভক্তরাও বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয়রাও এই মন্দিরে আসেন মাতৃদর্শনে।শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় তামিল ভক্তরা মন্দিরে বিশেষ পূজার আয়োজন করেন। হাওড়া থেকে বাসে মন্দিরতলা বা শিবপুর বাজার এসে টোটোয় অনায়াসেই এই মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
(৭) মাকড়চন্ডী মা, হাওড়া:
প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি পুরানো মাকড়চন্ডী মায়ের মন্দির, যা অবস্থিত হাওড়া জেলার ডোমজুর থানার অন্তর্গত মাকড়দহ গ্রামে।
শোনা যায় বহু পূর্বে এই মন্দিরের পিছন দিয়ে নাকি সরস্বতী নদী বয়ে যেত যদিও বর্তমানে তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। সেই সময় শ্রীমন্ত সওদাগর নামে কোন এক সওদাগর সরস্বতী নদীর ওপর দিয়ে বাণিজ্যে যাবার সময়
স্বপ্নদেশ পেয়ে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই সময় পাতাল থেকে ১০ ফুট উচ্চতার এক প্রস্তর খণ্ড পাতাল থেকে উঠে আসে ও সেটা কেই মাতৃ রূপে পূজা করা শুরু হয়। এই ভাবেই বেশ ভালো ভাবে মায়ের পূজা চলছিল, কিন্তু হঠাৎ এক দিন পূজা করতে করতে মন্দিরের পুরোহিত মাকে বলেন -” মা রে তোর উচ্চতা এত বেশি যে আমি তোর ভালো ভাবে সেবাই করতে পারি না, তো মুখ পর্যন্ত আমার হাত পৌঁছয় না রে মা, তুই একটু নিচু হয়ে পরিস নে মা!” এর পরেই মায়ের মূর্তি পাতালে নেমে যেতে থাকে, তখন পূজারী পূজা ছেড়ে মা কে জড়িয়ে ধরে, সেই থেকেই মায়ের মূর্তি এত ছোট।
এরপর কালের চক্রে মন্দির লতা পাতায় ঢেকে যেতে থাকে। অবশেষে ১৭৪৩ সালে জমিদার রামকান্ত কুণ্ডু চৌধুরী এই মন্দির পুনঃনির্মাণ করেন। শোনা যায়, এই জমিদার ছিলেন অন্ধ, কিন্তু মন্দিরের এসে তিনি তাঁর দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান। তাঁর নির্মিত মন্দিরে আজ আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে পেতে বর্তমান মন্দিরে এসে দাঁড়িয়েছে।
মায়ের মূর্তি এখানে শিলাময়ী , সেটা লাল সিঁদুরে রাঙানো ও তাতে স্বর্ণের ত্রিনয়ন, অলংকার ও কান পাসা দিয়ে সাজানো।
প্রতিদিন মায়ের নিত্য পূজা হয় সঙ্গে নিরামিষ ও আমিষ দুই প্রকার ভোগই মাকে নিবেদন করা হয়।
ভোগে থাকে খিচুড়ি, চচ্চড়ি,তরকারি,পাঁচ রকম ভাজা ও আমিষ ভোগে থাকে মাছ, পরমন্ন,চাটনি।
মায়ের বিশেষ পূজা হয় দুর্গা পূজা ও পঞ্চম দোলের দিন।
এই সময় এক মাস ব্যাপি মেলা ও উৎসব চলে।
(৮) শ্মশানকালী:
শ্মশানেশ্বরী কালিকার ধ্যান মন্ত্র এবং কলকাতার বুকে কেওড়াতলা শ্মশানের ভয়ঙ্করী শ্মশান কালী ও কৃষ্ণ কালীর এক স্থানে নিবাসের মাহাত্ম্য কথা অনেকেরই অজানা।
এখানে দেবীকে কাজল বা অঞ্জন পর্বতের মতো গাঢ় কালো বর্ণযুক্তা এবং শ্মশানের নিবাসিনী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর চোখ দুটি রক্তবর্ণ এবং কালো কেশরাশি মুক্ত বা খোলা। তিনি শুষ্ক মাংসের মতো ওনার শরীরের গঠন অর্থাৎ রোগা,অতিভয়ঙ্করী রূপে বিরাজমানা। দেবীর চোখ পিঙ্গল বর্ণ এবং তাঁর বাম হাতে মদ্যে পূর্ণ একটি নরমুণ্ড (কপাল) রয়েছে। অন্যদিকে, তিনি ডান হাতে সদ্য কাটা একটি মস্তক ধারণ করে আছেন, যিনি সদা কল্যাণময়ী শিবা। তাঁর মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে এবং তিনি চামড়া ও মাংস চর্বণ করতে সর্বদা তৎপর। নানা প্রকার অলঙ্কারে তাঁর অঙ্গ সজ্জিত হলেও তিনি দিগম্বরী (নগ্ন), এবং সর্বদা কারণপান করে মত্ত বা বিভোর। এই মন্ত্রে দেবীর সংহারক ও মুক্তিদাত্রী উভয় রূপই প্রকাশিত হয়েছে।
দেবী শ্মশানেশ্বরী সাধারণ গৃহীদের আরাধ্যা নন, তান্ত্রিক, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা, সাধিকা ভৈরবীরা, গুরু দীক্ষা নিয়ে গুরুদেবের কৃপায় কেবল শ্মশান কালীর আরাধনা করতে পারেন। কথিত আছে, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীমা সারদা একবার দেবীর পুজো করেছিলেন। তবে ঠাকুর বলতেন, গৃহস্থ বাড়িতে পুজো তো দূরের কথা, এমনকি শ্মশানকালীর ছবি রাখাও অনুচিত। কারণ, উপযুক্ত তন্ত্রগুরু ব্যতীত এই কালীর উপাসনা অসম্ভবের নামান্তর এবং গৃহের জন্য বিপজ্জনকও বটে।
কেওড়াতলা শ্মশানে এইরকম আবহেই গত ১৫০ বছর ধরে পুজো হয়ে আসছেন মা শ্মশান কালী। এখানে শ্মশান মায়ের রূপ থেকে শুরু করে পুজো সমস্তটাই ব্যতিক্রমী অন্যান্য কালীপুজোর তুলনায়। অন্যান্য জায়গায় আমরা কালী মূর্তির জিভ বেরিয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু কেওড়াতলা শ্মশান কালীর জিভ বেরোনো থাকে না। এখানে মায়ের রূপ খুবই শান্ত এবং স্নিগ্ধ। এই শ্মশান কালীর মূর্তিও বংশ পরম্পরায় একই শিল্পী এবং তাঁর পরিবার করে আসছেন। শিল্পী অরুণ পাল এই শ্মশান কালীর মূর্তি বানানো শুরু করেছিলেন এবং বংশপরম্পরায় তাঁরই পরিবারের লোকজন, বর্তমানে তাঁর স্ত্রী শ্মশান মায়ের মূর্তি বানান। যেমন এখানে একই শিল্পী বংশ পরম্পরায় মায়ের মূর্তি বানিয়ে আসছেন, ঠিক তেমনই শ্মশান কালী মায়ের পুজোও করেন বংশপরম্পরায় একই পুরোহিত। এই শ্মশানেই রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। যেখানে বসে সাধকেরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এছাড়া এই শ্মশানেই বিরাজ করছেন মহাকাল শিব। এছাড়াও এই শ্মশান কালী পুজো হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে। এই পুজোতে সূরা এবং মাংসের ব্যবহার করা হয়। এই পুজোর প্রধান পুরোহিত অরুণ ঠাকুরের কাছ থেকে জেনে নেওয়া গেল কিভাবে শ্মশান মায়ের পুজো হয়। অরুন ঠাকুর জানালেন, ‘ শ্মশান কালীমায়ের পূজা হয় বিরাচার তন্ত্রমতে। এই শ্মশান কালীর পুজোর একটা নিজস্বতা রয়েছে। এখানে যেমন বিরাচার তন্ত্রমতে পুজো করা হয় তেমনই, এই পুজোয় বিশেষ কিছু ক্রিয়া করা হয়, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা নিষেধ। অরুণ ঠাকুরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন শ্মশান কালী মায়ের জিভ অন্যান্য কালী মূর্তির মত বাইরে বেরিয়ে নেই? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, পুরান মতে মা অসুরকুল নিধন করে, শ্মশানে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং সূরা ও মাংস পান করছিলেন। জীবকুল এসে তখন মায়ের আশীর্বাদ নিচ্ছিল। সেই সময় মায়ের যে রূপ ছিল, শান্ত, স্নিগ্ধ, এখানে দেবী শ্মশান কালী মাতা ও সেই রূপেই পূজিত হন। আর সেই সময় যেহেতু মা খাচ্ছিলেন, তাই তাঁর জিভ বাইরে বেরিয়ে থাকে না। তাছাড়াও মা এখানে দ্বিভূজা। মা এখানে মূলত কল্যাণময়ী রূপে পুজিত হন।’ জানা যায়, শ্মশান কালী মায়ের পুজো শেষ হলেই, পুজোর ঘট শ্মশানের ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। কথিত আছে,মায়ের পুজো এত জাগ্রত,যখন শ্মশান মায়ের পুজো শুরু হয়, তখন কোনও না কোনও শব বা কোনও সধবা-র শব অবশ্যই আসে কাঠের শ্মশানে পোড়ানোর জন্য। একদিকে শব পোড়ানো শুরু হয়, আর অন্যদিকে শুরু হয় মায়ের পুজো। এখানে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৫ টা ছাগবলি হয়। পুজো কমিটির তরফ থেকে দুটো ছাগ বলি দেওয়া হয়। আর বাদবাকি মানুষের মনস্কামনা পূরণ হলে তাঁরা শ্মশান মায়ের সামনে ছাগবলি দেন। কথিত আছে , শ্মশান মা জাগ্রত এবং সকলের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। এখানে যে ছাগ বলি হয়, সেই বলির মাংসই রান্না করে মাকে নিবেদন করা হয়। তাছাড়াও প্রায় ৬০০ কিলো চাল-ডালের ভোগ হয় এখানে। পুজো শেষে যা জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বলা হয়, এই পুজো হরিজনদের। চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ডোম। ডোম এবং তাঁদের পরিবার এই পুজোর সমস্ত আয়োজন করে থাকেন। শ্রী শ্রী সাহানগর কেওড়াতলা শ্মশান কালীমাতা পূজা কমিটির সেক্রেটারি উৎপল সাহা জানালেন, এটা হরিজনদের পুজো। আমরা তাঁদের সাহায্য করে থাকি। মায়ের অলৌকিক কৃপায় এখানে আমাদের পুজোর বাজেট নিয়ে কোনদিন চিন্তা করতে হয় না। কিভাবে যেন মায়ের পুজো এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ের এত বিপুল খরচের টাকা ঠিক উঠে আসে।
(৯) কৃষ্ণ কালী মন্দির, কেওড়া তলা মহাশ্মশান:
চতুর্ভুজা দেবীর এক হাতে রয়েছে খড়গ অন্য একটি হাতে রয়েছে চাঁদ মালা। অর্থাৎ একদিকে যেমন তিনি ভয়ংকরী অন্যদিকে তিনি শান্ত সুশীলা। তার সামনের দুটি হাতে আবার রয়েছে কৃষ্ণের মতন বাঁশি। ঠিক যেমনভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার দুই হাতে বাঁশি ধরে থাকতেন। তেমনভাবেই দেবীর এই ভঙ্গিমায় যেন ধরা পড়েছে শ্রীকৃষ্ণ। দেবীর গায়ের রং নীল অর্থাৎ কৃষ্ণ যেমন শ্যাম বর্ণ তেমনভাবেই দেবীর রূপ ফুটে উঠেছে। অথচ দেবীর অগ্র জিহ্বা প্রসারিত। একই অঙ্গে দুইরূপ ধারণ করেছেন তিনি। স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে, মা মহাকালীর ভক্ত আনন্দঋষি প্রায় ১৫০ বছর আগে তীব্র সাধনা বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনে নিযুক্ত হয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনাথানন্দ নামে আরেক ঋষিও এখানে সাধনা করেছিলেন।
কালীঘাটে শক্তিপীঠের কাছাকাছি এমন ভাবেই পুজিত হয়ে থাকেন দেবী কালী। একদিকে কৃষ্ণ অন্যদিকে কালী দুই ভাবেই তাকে পূজন করা হয়। বস্ত্র এবং অলংকারে তিনি সজ্জিত । দেবী যেন বাঁশি বাজাচ্ছেন এখানে। আবার একই সাথে তিনি সংহার কারিণী।
কৃষ্ণ এবং কালিকে একসঙ্গে দর্শন করতে গেলে অবশ্যই যেতে হবে দক্ষিণ কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানের পাশে এই মন্দিরে। কাঠের চুল্লির একেবারে বাঁদিকে রয়েছে এই মন্দির সেখানে একই অঙ্গে বসবাস করছেন কালী এবং কৃষ্ণ।
(১০) ফুল্লোরা মা, বীরভূম:
বীরভূমের লাভপুরে লোকবিশ্বাস অনুসারে, ফুল্লরায় মা সতীর নিচের ঠোঁটটি পড়েছিল। এই মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। সিন্দুরচর্চিত কচ্ছপাকৃতি শিলাখণ্ডই দেবীর প্রতিভূ। এই মন্দিরের পাশে একটি বিরাট পুকুর আছে। কথিত আছে রামের দুর্গাপূজার সময় হনুমান এই পুকুর থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। ফুল্লরা ভারতের ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম। এখানে মায়ের ভৈরব “বিশ্বেশ”।
(১১) ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি:
১৭০৩ খ্রিস্টাব্দ। সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চল তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলের ভেতর এক শ্মশানে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামের এক তন্ত্রসাধক নিজ হস্তে মাটি দিয়ে মাতৃমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সিমিত ক্ষমতায় তিনি মাটির দেওয়াল তুলে, মাথায় তাল পাতার ছাউনি দিয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। যখন যাত্রীরা এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতেন তখন দূর থেকে এই মন্দিরের ঘন্টার ‘ঠন্-ঠন্’ শব্দ শুনতে পেতেন। সেই থেকে লোক মুখে এর নাম হয় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি।
পরে ১৮০৬ সালে, মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করে বর্তমান রূপ দেন ব্যবসায়ী শঙ্কর ঘোষ। মূলমন্দিরের পাশে আটচালা পুষ্পেশ্বর শিব মন্দিরটিও তাঁরই নির্মিত। বর্তমানে তাঁর বংশধররাই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত। এই শঙ্করবাবুর পৌত্র হলেন শ্রীশ্রী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম শিষ্য স্বামী সুবোধানন্দ।
তাঁর সহিত ঠাকুরের বেশ কয়েকবার এই মন্দিরে আগমন ঘটে। তিনি এখানে মা সিদ্বেশ্বরীকে গান শোনানোর পাশাপাশি জনগণের উদ্দেশ্যে অনেক মহৎ বাণী দিয়েছিলেন যা আজও মন্দিরের দেওয়ালে লেখা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘শঙ্করের হৃদয় মাঝে, কালী বিরাজে’।
এই মন্দির ভারতবর্ষের গুটিকয়েক মন্দিরের মধ্যে একটি যেখানে প্রায় প্রতিদিনই আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। শুধুমাত্র দীপান্বিতা অমাবশ্যা ও ফলহারিণী অমাবশ্যায় মাকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। বলা হয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও নাকি মাকে একবার ডাব-চিংরি নিবেদন করেছিলেন এখানে।
(১২) আনন্দময়ী কালী:
গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে খুব কাছেই, অনাথ নাথ দেব বাজারের পিছনের দিকে, একটি দালান আকৃতির মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রাচীরে একটি ফলকে উল্লেখ আছে প্রতিষ্ঠাবর্ষ—বাংলাব্দ ১১২৫ (অর্থাৎ ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং সেখানে “মতিলাল দেব শর্মা” নামে এক ব্যক্তির নাম খোদাই করা আছে।
মন্দিরটি ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রতিটি অমাবস্যায় (যেমন ফলাহারিণী কালীপূজা, দীপান্বিতা কালীপূজা এবং রটন্তী কালীপূজা) বিশেষ পূজা পালিত হয়। আজ থেকে তিন শতাব্দী আগে কলকাতার চেহারা একেবারেই ভিন্ন ছিল। তখন মন্দিরের আশেপাশের এলাকা ছিল ঘন বনাঞ্চল। ঐ সময়ে মিত্ররা ছিলেন এই এলাকার জমিদার।
মতিলাল দেব শর্মা, যিনি বর্তমান সেবায়েত পরিবারের পূর্বপুরুষ, এক রাতে স্বপ্নে এক বিরল দেবীমূর্তি দেখেন। স্বপ্নে তিনি দেখেন, মা কালী শিবের বুকে আসীন। পরদিন তিনি সেই দেবীমূর্তিটি পেয়ে স্থানীয় জমিদারের সহযোগিতায় মন্দিরে প্রতিস্থাপন করেন। এই মূর্তির ভঙ্গিটি সত্যিই অনন্য—যেখানে সাধারণত মা কালীকে শিবের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখানে তিনি শিবের বুকে বসে আছেন। নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যায়, শিবের মাথাটি দেবীর ডানদিকে অবস্থিত। দেবীর ডান পাশে নীলবর্ণের কালভৈরবের একটি মূর্তি রয়েছে, হাতে ত্রিশূল। এই দেবীকে “আনন্দময়ী বসা কালী” নামে লোকমুখে পরিচিত।
প্রতিটি অমাবস্যায় দেবীর উদ্দেশ্যে “অন্নভোগ” নিবেদন করা হয়—যার মধ্যে থাকে লুচি, শোল মাছ, পায়েশ, পাঁচ রকমের ভাজা ও মিষ্টি। এখানে এখনও পশুবলি দেওয়া হয়, যদিও এখন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মূল প্রবেশদ্বারের ডান দিকে বলিদানের স্থানটি দেখা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম আসতেন এই মন্দিরে নিজের রচিত গান শোনাতে মা শ্যামা সুন্দরী কে।
(১৩) ‘ঘোমটা কালী’ , উত্তর কোলকাতার শ্যামপুকুর:
একমাত্র মা কালীর রূপ ঘোমটা কালী। প্রসঙ্গত, এই মন্দিরটি সরকার থেকে হেরিটেজ সম্মানে সম্মানিত।
বলরাম ঘোষ স্ট্রিটে অবস্থিত এই মন্দিরটি আনুমানিক ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে (১২৯৫ বঙ্গাব্দে) বৈশাখ মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। বলরাম ঘোষের বংশের বধূ শ্রীমতী দয়াময়ী দাসী মন্দির তৈরি শুরু করলেও তিনি তা সম্পূর্ণ দেখে যেতে পারেননি তার আগেই পরলোক গমন করেন এবং পরবর্তীতে তার পুত্র সারদাপ্রসাদ ঘোষ সেই কাজ সম্পূর্ণ করেন। মূল গর্ভগৃহ ছাড়াও দু-পাশে রয়েছে দুটি আটচালাবিশিষ্ট শিবমন্দির। শিবমন্দিরে দুটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ হরেশ্বর ও হরপ্রসন্ন নামে পূজিত হন।
মা ভবতারিণীর পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে, অন্নভোগ হয় না। নুন ছাড়া লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, মিষ্টান্ন ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়।
(১৪) মা কিরীটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদ:
কিরীটেশ্বরী। সতীর ৫১ পীঠের একটি। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ কোর্ট রোড রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে যেতে হলে নৌকায় নদী পেরিয়ে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরেই পৌঁছানো যায় এই সতীপীঠে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এখানে সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের কণা পতিত হয়েছিল। অনেকে বলেন, দেবীর কিরীট বা মুকুট সংবলিত কপালের উর্ধ্ব ভাগ পড়েছিল এই স্থানে। সেই থেকেই নাম হয়েছে কিরীটেশ্বরী। এখানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কিরীটেশ্বরী কালী নামে পরিচিত।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই অঞ্চলটি ভারতের সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। শোনা যায়, নবাব মীরজাফর তাঁর মৃত্যুশয্যায় কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মা কিরীটেশ্বরীর পবিত্র চরণামৃত চেয়েছিলেন। সবদিক থেকে বিচার করে তাই এই কিরীটেশ্বরী মন্দির মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীনতম, পবিত্রতম এবং একটি বিখ্যাত ধর্মীয় স্থান যা মুকুটেশ্বরী মন্দির নামেও অনেকের কাছে পরিচিত ।
(১৫) নৈহাটীর ভবতারিণী বড়মা:
“ধর্ম হোক যার যার বড়মা সবার”
জয় বড় মা জয় বড়মা
নৈহাটির অরবিন্দ রোডের ২২ ফুট, চলতি কথায় ১৪ হাতের বড় কালীকে ‘বড় মা’ বলেই ডাকেন। শুধু নৈহাটি নয় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখানকার মা “বড় মা” নামেই পরিচিতা।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করা দরকার যে নৈহাটির সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে প্রাচীন আর সবচেয়ে শ্রদ্ধার কালীপূজা এটি
এতটাই শ্রদ্ধার যে, বড় মা বিসর্জনের আগে শহরের আর কোনও ঠাকুরের বিসর্জনই হয় না। সবার আগে পথ ছেড়ে দেওয়া হয় এই মাকে।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এই পূজার শুভ সূচনা হয়েছিল। ১৯২০ সালে স্বর্গীয় ভবেশ চক্রবর্তী মহাশয়ের বাড়ীর বিপরীতে ক্যাওড়া পাড়ায় প্রতি বছর রক্ষা কালী পূজা হতো। ক্যাওড়ারাই এই পূজার দায়িত্ব পালন করতো। তখন এই মাতৃ প্রতিমার বিগ্রহটি উচ্চতায় ছোটো ছিল।পূজার শেষে মাকে মিষ্টি ও ডাবের জল দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হতো। সেই সময় কোনো অন্নপ্রসাদ নিবেদন করা হতো না।
১৯২৭ সালে ভবেশ চক্রবর্তী ও তার চারজন বন্ধু,তাঁরা হলেন, রাখাল চন্দ্র দে, গদাই মোদক, প্রমথ চক্রবর্ত্তী ও ভদ্রেশ্বর পাত্র। ভাঙ্গা রাস উৎসব উপলক্ষে নবদ্বীপ ধামে যান। পোড়ামা তলার সুউচ্চ মহিষ মর্দ্দিনী দেবীর বিগ্রহ দেখে অভিভূত হন ভবেশ চক্রবর্তী। এরপর আরও উচ্চতা বিশিষ্ট রাধাকৃষ্ণ, কালী, শিব প্রভৃতি দেবদেবীর বিগ্রহ দর্শন করে ধন্য হন তাঁরা।
লোকশ্রুতি মতে, ভবেশ চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নেন নৈহাটির যার পূর্ব নাম নবহট্ট; অরবিন্দ রোডের ভিতরে ক্যাওড়া পাড়াতেই সুউচ্চ কালী বিগ্রহ স্থাপণ করে পূজা করবেন। লক্ষ্মী পূজার আগের দিন তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন গঙ্গার তীরবর্তী ধর্মশালার সন্নিকটে দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার পূণ্য লগ্নে যেন মায়ের পূজা করা হয়। পরের দিন সকালে ব্যারাকপুরের স্বনামধন্য ভাস্কর বিশ্বনাথ পাল মহাশয়কে ভবেশ জানান, সুউচ্চ কালী প্রতিমা নির্মাণের জন্য। তিনি ভবেশ বাবুর কথায় রাজী হন এবং ধর্মশালার সন্নিকটে কালী মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ শুরু করেন। অবশেষে কালী পূজার আগের দিন মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এই কালী বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় ২২ ফুটের ওপর ছিল। মায়ের বিগ্রহ কে রুপোর গহনা, চাঁদ মালা, খড়গ, মুন্ডুমালা ইত্যাদি পরানোর পরে পূজা পাঠ শুরু হয়। সেই সময় খাসবাটি নিবাসী জগমোহন আচার্য এই পূজা করেছিলেন। তারপর খিচুড়ি, অন্ন, তরকারী, পায়েস প্রভৃতি দিয়ে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হল। দুইদিন ধরে এই পূজা করার পরের দিন বিকেলে মায়ের শ্রী বিগ্রহকে বিসর্জনের জন্য কাঁধে চাপিয়ে গঙ্গাবক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় লোকজনের সংখ্যাও তুলনামূকভাবে অনেক কম ছিল সেই জন্য জুট মিলের লোকজন ও কুলীরা এতে অংশগ্রহণ করত। এই ভাবেই মায়ের নিরঞ্জন সুদীর্ঘ ৫০ বছর ধরে একই রীতি অনুসারে পালিত হয়। এরপর ১৯৭০ সাল থেকে মা এর কাঠামোতে চাকা লাগিয়ে রথের ন্যায় দড়ি দিয়ে টেনে গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দেওয়া শুরু হয়। সেই নিয়মই এখনো পর্যন্ত পালন করা হয়ে থাকে। নিয়মের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।
কেন এই বড়ো মায়ের নামকরণ?
১৯২৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই দেবী “ভবেশ কালী” নামে সুপ্রসিদ্ধা ছিল। ২০১২ সালে অমলেশ চক্রবর্তীর দেহত্যাগের পর এই পূজা সার্বজনীন হয়ে যায়।
মা কে সঠিক সময় প্রসাদ না দেওয়া, কোনো রকমে পূজা সমাপ্ত হওয়া এই নিয়ে অনেকেই মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন সেই জন্যই ভবেশ চক্রবর্তীর পরিবার থেকে এই পূজা সার্বজনীন হয়। ২০১২ সালের পর থেকে নৈহাটির মানুষেরা “বড় কালী” নামে আখ্যা দিয়েছেন এই। মাকে। যেহেতু নৈহাটি অঞ্চলের সর্বপ্রাচীন এই পূজা এবং মহা এই দেবী তাই জন্য সকলেই অন্তর থেকে “বড়মা” সম্বোধন করেন।
এবার আসা যাক বড়মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা ও নিত্য পূজাপাঠ সম্বন্ধে:
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রেমচুক মারোয়ারী ধর্মশালা সমাজ বিরোধী কাজের জায়গায় রূপান্তরিত হওয়ার কারণে ২০১৩ সালে “বড়মা কমিটি” সেই স্থানটিকে ঘিরে একটি ছোটো মন্দির তৈরী করে দেন। সেখানেই নিত্য পূজা পাঠ করা হয়। কালীপূজা ছাড়াও ১১ টি অমাবস্যায় মায়ের আরাধনা হয়ে থাকে। কালীপূজার পরে পূর্ণিমার দিনে সত্যনারায়ণ বিগ্রহ নির্মাণ করে পূজা করা হয়ে থেকে।
বড় মায়ের পূজাপর্ব ও দেবী মাহাত্ম্যের বলতে প্রথমেই বলতে হয় লক্ষ্মী পূজার দিন কাঠামো পূজা হয়। তারপরের দিন থেকেই মায়ের বিগ্রহ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায়।
বর্তমানে মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ করেন রাজু বিশ্বাস।
বিগ্রহের উচ্চতা ১৪ হাত বা ২২ ফুট। বড় মায়ের পূজার জন্য কোনো চাঁদা তোলা হয় না। ভক্তদের দান করা অর্থ ও নিবেদিত অলংকারে মা পূজিতা হন। প্রণামী বাক্সে যেমন ভাবে টাকা পয়সা দেয় ভক্তরা ঠিক তেমন ভাবেই সোনা, রূপার অলংকারও দেন। মায়ের বিগ্রহকে সোনার ও রুপোর অলংকারে সুসজ্জিতা করা হয়। সোনার পরিমাণ ১০০ ভরি এবং ২০০ কিলোর কাছাকাছি রুপো। মায়ের পরিধেয় মুকুটটিতে রুপো আছে ৪.৫ কেজি। রুপোর মুন্ডুমালা, কোমরবন্ধনী, খড়গ, শিবের মুকুট, ত্রিশুল, বিল্ব পত্র প্রভৃতি রূপো দ্বারা নির্মিত। মাকে সুসজ্জিত করার পর পূজা পাঠ শুরু হয়।
বর্তমানে বড় মায়ের পূজা করেন সত্যরঞ্জন চক্রবর্তী।
তার হাতেই মায়ের পূজা জাগ্রত হয়েছে। কালী পূজার দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন বড় মা কে দর্শন করতে।
লোকশ্রুতি আছে যে যা মনস্কামনা জানান মায়ের কাছে তাই পূর্ণ করেন এই বড় মা। হাজার হাজার লোক এদিন দন্ডী কাটেন এবং সিক্ত বস্ত্রে মায়ের চরণকমলে মাথা রাখেন।
ভোগ নিবেদনের বিষয়:
যেহেতু পাঁচদিন বড় মা থাকেন, সেই জন্য প্রতিদিন মোট ৫০০০ কেজির ওপর ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন ২০০০ কিলোর ভোগ হয়। পুরোটা রান্না করা হয় গাওয়া ঘি দিয়ে। কোনো তেল ব্যবহার করা হয় না। রাতে বড় মায়ের ভোগে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, লুচি, অন্ন ভোগ, পাঁচ রকম ভাজা(বেগুন, ঢেঁড়স, কুমড়ো, আলু, কাঁচকলা), চাটনি, পায়েস প্রভৃতি।
পূর্বরীতি অনুযায়ী ভবেশ চক্রবর্তী মহাশয় এর বাড়ি থেকে এই ভোগ রন্ধন করে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।
সকালে কুচো ফলের নৈবেদ্য ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় শীতলী প্রসাদে লুচি, লাড্ডু, নাড়ু, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া নিবেদন করা হয়।
তাছাড়া বছরের ১১ টি অমাবস্যায় ৭০০ কেজির উপর ভোগ হয়।
ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যায় ১৭০০ কেজি ভোগ হয়।
বৈশাখ মাসে অন্নকূট উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বড় মায়ের মন্দিরে। পোলাও ভোগ পর্বতসম করে তার উপর ফুল দিয়ে সাজিয়ে নিবেদন করা হয়। সেই প্রসাদ নিতে হাজার হাজার লোক ছুটে আসেন মন্দিরে।
বিসর্জন পর্ব:
মোট চারদিন ধরে হয় পূজা। তারপরের দিন বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের দিন মায়ের এই সকল অলংকার খুলে রাখা হয়। তার পরিবর্তে ২ লক্ষ টাকার ফুলের সাজে সজ্জিতা হন বড়মা। এই সাজেই মা নিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হন। কেবলমাত্র মায়ের ও বাবার স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত ত্রিনয়ন সহ বিসর্জন দেওয়া হয়। মায়ের মুখে পান, মিষ্টি ও জল দিয়ে বরণ করেন কমিটির সম্পাদক।
এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরুষেরাই মায়ের বরণ করে। আর মায়ের মুখে পান পড়ে গেলে মা কে আর আটকানো যাবে না। ঠিক চারটের সময় মায়ের বিগ্রহকে টেনে নিয়ে নৈহাটির গঙ্গা বক্ষে রওনা হয়। এই ভাবে মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
সেবা ও দান – ধ্যান এর মাহাত্ম্য:
বড় মায়ের যজ্ঞে নিবেদন করা কলা খেয়ে অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকী কোনও নিঃসন্তান নারী এই হোমের কলা খেলে সন্তান লাভ করেন বলেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
বড় মায়ের পূজায় যে ফল নিবেদন করা হয় সেই ফল নৈহাটি মাতৃ সদন, ইমামবাড়া প্রভৃতি হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের মধ্যে দান করা হয়।
বড় মায়ের কাছে ৩০-৪০ এর বেশি বেনারসি শাড়ি পূজাতে আসে প্রতি বছর। সেই সমস্ত শাড়ি বিবাহের জন্য দুঃস্থ মহিলাদের দান করে দেওয়া হয়।
এছাড়া কালীপুজার কিছু দিন পর বস্ত্রদান উৎসব করে দরিদ্র মানুষের মধ্যে ভক্তদের নিবেদিত বস্ত্রগুলি বিলিয়ে দেওয়া হয়।
এই ভাবেই আজকে পশ্চিমবঙ্গে বড়ো মায়ের নাম দিকে দিকে প্রচারিত। যে যা মানত করেন বড়মা তার সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ করেন। মা এখানে জ্যান্ত। মায়ের দুই কান খোলা। মা কাউকে খালি হাতে ফেরান না।
(১৬) লেক কালীবাড়ি:
১৯৪৯ সালে তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও মন্দিরটির আরেক নাম “শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির”। প্রথমে মন্দিরটি শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির নামেই পরিচিত ছিল। দক্ষিণ কলিকাতার রবীন্দ্র সরোবর অর্থাৎ ঢাকুরিয়া লেকের বিপরীতে মন্দিরটি অবস্থিত হওয়ায় লেকের পাশ্ববর্তী সার্দান অ্যাভিনিউের এই মন্দিরটি লোক মুখে লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিটির নাম করুণাময়ী মা।
এই কালীবাড়ি ঘিরে নানান কাহিনী ও গল্প শোনা যায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মা কালীর ভক্ত তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি মায়ের সাধনা করতেন। সাধারন মানুষের কাছে তিনি ছিলেন গুরুদেব। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাধনায় খুশী হয়ে মা কালী তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন। তন্ত্রসাধনার উদ্দেশ্যে হরিপদ চক্রবর্তী পাঁচটি নরমুণ্ড দিয়ে একটি ‘পঞ্চমুণ্ডির আসন’ তৈরি করেন। এখনও কালীমূর্তির পাশে এই পঞ্চমুণ্ডির আসন রাখা রয়েছে। মন্দিরের পাশের ঘরে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি রয়েছে। হরিপদ চক্রবর্তী নিজে একজন তান্ত্রিক ছিলেন। মাতৃসাধক হরিপদ চক্রবর্তীর কারণেই কালীমন্দিরের মাহাত্ম্য ক্রমে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিদিন নিত্যপুজো হয়। সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবারও বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। ভক্তদের জন্য প্রতি মঙ্গলবার এবং শনিবার মন্দিরে ১৫ মিনিট অন্তর অঞ্জলি দেওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। পুজোর সময় এখানে সাজ বদল হয় দেবীর। বর্তমানে এখানে করুনাময়ী কালীমাতা ট্রাস্ট নামক একটি ট্রাস্ট বোর্ড রয়েছে, যারা এই কালীবাড়িটি পরিচালনা করেন। লেক কালিবাড়ির উল্টোদিকের সুজ্জিত পার্কে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
মন্দিরের ভিতরে মা বগলা, ধুমাবতী, সন্তোষী মায়ের মূর্তি রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত এই লেক কালীবাড়িতে দক্ষিণা কালীর পুজো হয়। আগামীতে মা শীতলা ও মা মনসা দেবীর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করার কথাও রয়েছে।
লেক কালীবাড়ির সঙ্গে লেক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, কালীবাড়ির রীতি মেনে পুজো শেষে ঘটের বিসর্জন হয় লেকে এবং তারপর লেক থেকেই জল তুলে রাতে আবার মা কালীর পুজো শুরু হয়।
কালী পুজোর দিন সারা রাত ধরে পুজো চলে, অঞ্জলি হয় একদম পুজোর শেষে। অর্থাৎ, অঞ্জলি হতে হতে ভোর হয়ে যায়। লেক কালীবাড়ি প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেকবারই কালীপুজোর দিন মাকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগের তালিকায় থাকে একাধিক রকমের মাছ, খাসির মাংস, পাঁচ রকমের ভাজা, পোলাও, পাঁচমিশালি তরকারি, পায়েস। পুজোর রাতে মা কালীকে এই ভোগ নিবেদন করা হয়। কালী পুজোর দিনে এখানে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। পশু বলি মানত করা নিষিদ্ধ এখানে। কালী পুজোর পরদিন ভোর থেকে মায়ের অন্ন ভোগ সাধারনের জন্য বিতরণ করা হয়।
প্রতি বছর ১৩ই এপ্রিল এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। ১০ই ফেব্রুয়ারি গুরুদেব শ্রী শ্রী হরিপদ চক্রবর্তীর জন্মদিনও পালিত হয় মন্দিরে। এছাড়া গণেশ পুজো, জগদ্ধাত্রী পূজাও বড় করে পালন করা হয়। বর্তমানে মন্দিরটির প্রধান সেবাইত নিতাই চন্দ্র বসু।
(১৭) শ্রী শ্রী শব শিব কালী মন্দির, বারাণসী:
শ্রী শ্রী শব শিব কালী মন্দিরটি বারাণসীর দেওনাথপুরা এলাকার “বাঙালি টোলা” অঞ্চলে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে মন্দিরটি “শব শিব” নামেই বিশেষ পরিচিত।
প্রায় ​২৩০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রাজা মহারাজা শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁর রাজগুরু ছিলেন “শ্রী চন্দ্রশেখর দেব শর্মা”, যিনি একজন মহান ও বিখ্যাত তন্ত্র সাধক ছিলেন। তিনিই ১৭৮৯ সালে এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বলা হয় সাধক চন্দ্রশেখর স্বপ্নে এমন মুর্তি গড়ার আদেশ পেয়েছিলেন স্বয়ং মা কালীর থেকেই।
​এই মন্দিরটি তার অনন্য বিশেষত্বের কারণে ভারত ও বিশ্বের হাজার হাজার ভক্তকে আকর্ষণ করে। দেবীর বিগ্রহ দক্ষিণ দিকে মুখ করে স্থাপিত এবং দেবী পঞ্চমুণ্ডির আসনে (তন্ত্র সাধনায় ব্যবহৃত হয়) উপবিষ্ট। দেবীর বিগ্রহের উত্তরে “অর্ধ শিবলিঙ্গ” অবস্থিত এবং শ্রী মহাকাল ভৈরবের অবস্থানও মা-এর সঙ্গে।
​“শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরি সংস্থিতাং”
​প্রতি অমাবস্যায়, স্থানীয় পুরোহিতরা অধিষ্ঠাত্রী দেবীর উদ্দেশ্যে বলিদান ও অর্ঘ্য নিবেদন করেন। চণ্ডী পাঠ, বগলা পাঠ এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এমনকী, নবরাত্রির সময় বিশেষ অর্ঘ্য নিবেদন, চণ্ডী পাঠ এবং যজ্ঞও নিরলসভাবে চলতে থাকে। এই মন্দিরে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম হয়, যারা মা এর কাছে তাঁদের প্রার্থনা নিবেদন করেন এবং তাঁর আশীর্বাদ চান। তাঁরা প্রতিদিনের আরতিতেও অংশগ্রহণ করেন এবং মায়ের আশীর্বাদের অধীনে তাঁদের জীবন কাটাতে চান।