অর্পিতা সিনহা, বাঁকুড়া (২৩ নভেম্বর,২০২০):অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় ইতুপুজো। সারা মাস ব্যাপী ইতুর আরাধনা করে থাকেন গ্রামবাসীরা।অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার ইতু পুজো করে ঐ মাসেরই সংক্রান্তির দিন পুকুর, নদী বা গঙ্গায় ইতু দেবীকে বিসর্জন দেওয়ার রীতি আছে।
‘ইতু’ শব্দটি ‘মিতু’ অর্থাৎ ‘মিত্র’ থেকে এসেছে।’মিত্র’ শব্দের অর্থ হল সূর্য।ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে সূর্যের আদিত্য নাম থেকে ‘ইতু’ শব্দের উদ্ভব। অগ্রহায়ন মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। সেইজন্য তিনি বলেছেন ইতুপুজো আসলে সূর্য পুজো।আবার অনেকেই বলেন প্রধাণত রবিবার ইতু পুজো করা হয় বলে এই পুজো সূর্য পুজো নামে প্রচলিত । ইতুপুজো প্রসঙ্গে ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বাংলা ‘লোকনৃত্য’ গ্রন্থে বলেছেন” যে সূর্যব্রত ভারতের সকল নারী সমাজের একটি প্রধান ব্রত”। আচার্য সুকুমার সেন ইতুকে আবার ইন্দ্রের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে মেয়েরা ইন্দ্রের মতো বর পাওয়ার জন্য ইন্দ্র- দ্বাদশীর দিন ইতু পুজো করে থাকেন। তবে মূলত গ্রামবাসীদের কাছে ইতু লক্ষ্মী রূপে পূজিত হন।আসলে সূর্যের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে ধান ও সমৃদ্ধির দেবী রূপিনী লক্ষ্মীর আরাধনাই ইতু পুজো।
গ্রাম বাংলার মেয়েরা নিজেরাই এই পুজো করে থাকেন। কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন একটি সরার মাঝখানে ঘট বসিয়ে তার চারদিকে ধান, হলুদ,মান কচু গাছ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে মটর সরষে, শুষনী,কলমী,জামাই নাড়ু, শিবের জটা , কাজললতা,সরষে ফুলের মালা,বটের ডাল,পাঁচটি অঙ্কুরোদ্গম ছোলা দিয়ে উপকরণ সাজিয়ে ইতুর ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল অঙ্কন করে চারিদিকে আলপনা এঁকে ইতুর আরাধনা করা হয়। ইতু লক্ষীর বিশেষ ভোগে থাকে সরুচাকলির পদ। ইতুর জনপ্রিয় ব্রত কথাটি লিখিত ও মৌখিক দুই রূপেই পাওয়া যায়। ইতুর ব্রতকথাটিতে রয়েছে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ও তাঁর দুই মেয়ে উমনো ও ঝুমনোর কাহিনীকে ঘিরে। একদিন দরিদ্র ব্রাহ্মণ অনেক কষ্ট করে পিঠের উপকরণ জোগাড় করেন নিজে একা খাওয়ার জন্য। তিনি তাওয়ায় পিঠে ভাজার আওয়াজ শুনে দড়িতে গিঁট দিয়ে পিঠের সংখ্যা গুনে রাখেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ এর স্ত্রী লুকিয়ে মেয়েদের দুটো পিঠে খাইয়ে দেন। এই পিঠে খাওয়ার অপরাধে ব্রাহ্মণ দুই মেয়েকে বনবাসে পাঠান। বনে গিয়ে উমনো,ঝুমনো ইতু পুজো করে আবার সমস্ত কিছু ফিরে পায়। সেই থেকেই ইতু পুজোর মাহাত্ম্যের প্রচলন হয়। ব্রত গল্পটিতে প্রাচীন বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন প্রথার সন্ধান মেলে যেমন মেয়েদের বনে পাঠানো, দড়িতে গিট দিয়ে গ্রন্থি লিপি কে স্মরণ, দুর্ভাগ্য জয় করে পুনরায় বাড়ি ফিরে আসা ইত্যাদি। আঞ্চলিক উপদেবী হিসাবে ইতু একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।