ঈশানী মল্লিক, কলকাতা: গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রার ইতিহাস সময়ের মতোই পুরনো। আমরা ভারতীয় মহাকাব্য “মহাভারতে” ও “বন পর্ব” বিভাগে এই তীর্থযাত্রার প্রাচীনতম নথিপত্র পাই। এটি তর্কযোগ্যভাবে ১৫০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে শুরু হয় বলে মনে করা হয়।
“বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ” দ্বারা ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সংবাদ পত্রে সেকালের কথা” অনুসারে, প্রথম কপিল মুনি মন্দিরটি ৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এবং এই সত্যের উৎস প্রথম ১৯ শতকের সংবাদপত্র “হরকরা পত্রিকা” তে প্রকাশিত হয়। এই সত্যটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে মহা কবি কালিদাসের সাহিত্যিক মাস্টারপিস “রঘুবংশম” দ্বারা নিশ্চিত করা যেতে পারে, যা তীর্থযাত্রার আভাস বর্ণনা করে।
মধ্যযুগীয় সময়ে, দেশের প্রতিটি কোণ থেকে তীর্থযাত্রীরা জলে কুমির এবং ঘড়িয়ালের জোড়া হুমকি এবং স্থলে বেঙ্গল টাইগারের ক্রোধকে সাহসী করে বিশ্বাসের ভূমিতে যেতেন। বিপদজনক যাত্রার সময়, তীর্থযাত্রীদের কলেরা এবং পক্সের মতো রোগের সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, লোকেরা অন্তত একবার এই দ্বীপে যেতেন আশা নিয়ে, যে এটি তাদের পাপ ধুয়ে ফেলবে। এই বচনের উৎপত্তি হয়েছে, “সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার।” এই বিপজ্জনক যাত্রার একটি আভাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আইকনিক মাস্টারপিস “কপালকুণ্ডলা”- তেও ক্রনিক করা হয়েছে।
কপিল মুনির মন্দিরে তার উপাদানগুলি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কপিল মুনি মন্দিরের বেশ কয়েকটি পুনরাবৃত্তিকে ধুয়ে দিয়েছে। স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে, বর্তমান মন্দিরটি আশ্রমের সপ্তম পুনরাবৃত্তি। এটি ১৯৭৩ সালে অযোধ্যার হনুমান গারি আশ্রমে মহন্ত (প্রধান পুরোহিত) আশ্রম রামদাস জি মহারাজের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল।
কপিল মুনির মন্দির, যার নির্মাণ কাজ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়েছিল
ভারতের স্বাধীনতার পরে, তীর্থক্ষেত্রটির উন্নতি শুরু হয়। তরুণদেব ভট্টাচার্য রচিত গঙ্গাসাগর মেলা ও প্রাচীন ঐতিহ্য গ্রন্থে মন্দিরের ছবি প্রকাশিত হয়। উক্ত গ্রন্থ অনুযায়ী, স্থায়ী মন্দিরটি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পরিণত মন্দিরের আকার আবির্ভূত হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭০-এর দশকে স্থায়ী মন্দির নির্মাণে সহায়তা করে। পরবর্তী দশকগুলিতে মেলায় তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমান সময়ে, গঙ্গাসাগর মেলা ও তীর্থক্ষেত্র উপলক্ষে প্রত্যেক বছর পৌষ মাসে মকরসংক্রান্তি বা পৌষ-সংক্রান্তির পূণ্যতীথিতে (জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি) লক্ষ্য লক্ষ্য লোকের সমাগম ঘটে।
পুরাণ মত:
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক কাহিনীগুলি আমাদের আধুনিক জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে, মেলার স্পন্দন প্রতিটি দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২০২১ এবং ২০২২ সালে ই-স্নান এবং ই-পূজার মতো স্কিমগুলি চালু করা হয়েছে। গঙ্গাসাগর মেলা ২০২৩ কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সর্বোচ্চ মানব সমাবেশের সাক্ষী।
গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক কাহিনী মূলত কথা বলে, জীবন ও মৃত্যুর বৃত্ত এবং মোক্ষ সম্পর্কে আর এই ভক্তির মুখ্য কেন্দ্রস্থল হল কপিল মুনির মন্দির। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কপিল মুনির পিতা ছিলেন মহর্ষি কর্দম মুনি এবং মাতা ছিলেন পৃথিবী শাসক স্বয়ম্ভব মনুর কন্যা দেবহূতি। কর্দম মুনি তাঁর পিতা ভগবান ব্রহ্মার আদেশ অনুযায়ী কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সামনে আবির্ভূত হন এবং কর্দম মুনিকে স্বয়ম্ভব মনুর কন্যা দেবহূতিকে বিবাহ করতে বলেন এবং ভবিষ্যতবাণী করেন, কর্দম মুনি ও দেবহূতির ৯টি কন্যা হবে এবং সময়ের সঙ্গে সমগ্র সৃষ্টিকে জীবিত সত্ত্বা দিয়ে পূর্ণ করবে। এছাড়াও ভগবান বিষ্ণু জানান, তিনি নিজে অবতার রূপে কর্দম মুনি ও দেবহূতির সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন এবং সমগ্র বিশ্বকে সাংখ্য দর্শন প্রদান করবেন। কপিল মুনি প্রথম জীবনে বেদের অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন এবং সাংখ্য দর্শনকে সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ করেন।
গঙ্গাসাগরের কিংবদন্তী শুরু হয় রামায়ণের রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা সগরের উপাখ্যান দিয়ে। ইক্ষাকু বংশের রাজা সগর ঋষি ঔর্বের নির্দেশে শত অশ্ব্মেধ যজ্ঞ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কথিত ছিল, কেউ যদি শত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে তাহলে সে সমগ্র পৃথিবীতে আধিপত্য অর্জন করতে পারবে। একমাত্র দেবরাজ ইন্দ্র তার আগে শত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। সাগরের শত অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্কল্প শুনে ইন্দ্র আশঙ্কিত হয়ে পড়েন সাগর সফল হলে তিনি মর্যাদা হারাবেন। ভীত ইন্দ্র, সাগরের যজ্ঞের অশ্ব কপিল মুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখেন।
যজ্ঞের অশ্ব খুঁজে না পেয়ে ক্রুদ্ধ সাগর, তার ৬০,০০০ পুত্রকে নিখোঁজ ঘোড়াটির সন্ধানে পাঠান। পথে সবকিছু ধ্বংস করতে করতে সাগরপুত্ররা পৌঁছন কপিল মুনির আশ্রমে। ধ্যানরত কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছে সাগরপুত্ররা অশ্বটি খুঁজে পেয়ে কপিল মুনির ধ্যানভঙ্গ করে এবং তাঁকে অপমান করে। ক্রুদ্ধ কপিল মুনি চোখ খুলে সাগরের ৬০,০০০ পুত্রকে ভস্ম করে তাদের আত্মা নরকে পাঠিয়ে দেন। বহু বছর পর, সাগরের বংশধর অংশুমান কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছে যজ্ঞের অশ্বটিকে খুঁজে পান। অংশুমান কপিল মুনিকে তুষ্ট করবার জন্য তপস্যা করেন। অংশুমানের তপস্যায় তুষ্ট কপিল মুনি অশ্বটিকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। কপিল মুনির কাছ থেকে অংশুমান জানতে পারেন,গঙ্গার পবিত্র জলে শ্রাদ্ধকর্মাদি করলে তবেই সাগরপুত্রদের আত্মা মুক্তি পাবে। কিন্তু অংশুমান বা তার পুত্র দিলীপ কেউই গঙ্গাকে মর্তে আনতে অসমর্থ হন। দিলীপের পুত্র রাজা ভগীরথ প্রথমে ব্রহ্মা ও পরে বিষ্ণুর আরাধনা করে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। সন্তুষ্ট ভগবান বিষ্ণু ভগীরথকে সতর্ক করেন, গঙ্গার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেই দুরন্ত বেগে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ভগীরথ তখন ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করেন, শিব যেন তার জটায় গঙ্গাকে ধারণ করে তার বেগ নিয়ন্ত্রণ করেন। শিবের জটায় গঙ্গার দ্রুতবেগ হ্রাস পায় এবং তারপর গঙ্গা মর্তে অবতরণ করেন। অবশেষে ভগীরথ পবিত্র গঙ্গা জলে তাঁর ৬০,০০০ পূর্বপুরুষের আত্মার শ্রাদ্ধকর্মাদি করে তাদের আত্মাকে নরক থেকে মুক্ত করেন।
যুগ যুগে এই সব পৌরাণিক কাহিনী কিংবদন্তি ও পরে কিংবদন্তি থেকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজা ভগীরথের নাম অনুসারে তাই গঙ্গার নাম হয় ভাগীরথী এবং রাজা সগরের নামে সমুদ্রের নাম হয় সাগর। সমুদ্র ও নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপের নাম হয় “সাগরদ্বীপ”।
পুজোর নিয়ম ও আচার:
পৌরাণিক এই আখ্যানে বিশ্বাস রেখে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী মোক্ষের সন্ধানে মকর সংক্রান্তির সময়ে গঙ্গাসাগর মেলায় যান। তারা বিশ্বাস করেন, সাগর সঙ্গমের পবিত্র জলে ডুব দিলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। বলা হয়, সঠিক মুহূর্তে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে সমস্ত অর্জিত পাপ ধ্বংস হয় এবং মোক্ষ অর্জিত হয়, একেই শাহি স্নান বলে। শাহি স্নানের পরেও, বেশকিছু আচার-অনুষ্ঠান পরবর্তী ৩ দিন ধরে পালিত হয়। এমনই একটি ধর্মীয আচার হল, পঞ্চরত্ন ও সূতা প্রদান। এই প্রথা অনুযায়ী, পঞ্চরত্ন ও পবিত্র সূতা নদীর খাতে ভাসানো হয়, যা নদীর স্রোতে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। এই সম্পূর্ন প্রথাটি ত্যাগের প্রতীক।
মকর সংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় ভক্তরা নির্বাণ প্রাপ্তির আশায় সাগরের ঠাণ্ডা জলে ডুব দেয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের মাথা ন্যাড়া করে আবার কেউ কেউ তাদের প্রয়াত পিতা-মাতার জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে। তারপর দুপুর অবধি চলে স্নানের আচার। স্নান হয়ে গেলে তারা পূজাপাঠের উদ্দেশ্যে কপিল মুনির মন্দিরে যায় এবং তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের জল ভক্তদের ভাসানো হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়, যা সেই মুহূর্তকে অসীম এক উচ্চতায় উন্নীত করে। এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কপিল মুনির মন্দির দর্শন করেন ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’।
পূজা ও আরতির সময়:
স্নানকাল: মকর সংক্রান্তির সূর্যোদয়ের সময়।
অর্ঘ্য প্রদান: গঙ্গাজল, দুধ, তিল ও ফুল দিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য।
দান: তিল, চাল, গুড়, পোশাক, ও অর্থ দান করলে অশেষ পুণ্য লাভ হয়।
পূজা: কপিল মুনির মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানো, ব্রাহ্মণ ভোজন ও গঙ্গা আরতি।
সংযম ও ব্রত: উপবাস, মনঃসংযম, এবং জপ-ধ্যান এই সময়ে বিশেষ ফলদায়ক।
সাধারণত মকর সংক্রান্তির প্রথম প্রহরে মেলা শুরু হয়। তীর্থযাত্রীরা ভোর ৩:০০ টা থেকে পবিত্র স্নান শুরু করতে পারেন। কপিল মুনি মন্দিরে, পবিত্র স্নানের পর সকালের আরতি অনুষ্ঠিত হয়, সাধারণত সন্ধ্যা ৭:০০ টার দিকে। মেলায় প্রবেশ বা আচার-অনুষ্ঠান করার জন্য কোনও প্রবেশ মূল্য নেই। কপিল মুনি মন্দিরে, প্রতিদিন আরতি এবং পূজা করা হয়, পবিত্র স্নানের পর সকালে মূল আচার-অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায়, হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় সমুদ্র সৈকত আলোকিত হয়, যা প্রতিটি ভক্তের জন্য একটি ঐশ্বরিক দৃশ্য তৈরি করে।
বৈতরণী পার:
গরুড় পুরাণের ৪৭তম অধ্যায়ে বৈতরণী নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই নদী জীবজগৎ ও মরজগতের মধ্যবর্তী সম্পর্কস্বরূপ। পুরাণে বলা হয়েছে, মৃতের আত্মারা এই নদী পার করে তবেই স্বর্গে পৌঁছন আর যারা কারও প্রতি কখনও সদয় হয়নি বা অন্যদের সাহায্য করেননি তাদের আত্মা এই নদী পেরোতে পারে না এবং নরকের অতল গহ্বরে পতিত হয়। কিন্তু সেইসব অসহায় আত্মা গরুর লেজ ধরে এই নদী পার হতে পারে। সেইকারণে মকর সংক্রান্তির দিন, অসংখ্য মানুষ সাগর পাড়ে ভিড় করেন গরুর লেজ ধরে ‘বৈতরণী পার’ আচার পালন করবার জন্য।
মকর সংক্রান্তির শুভ সময়ে প্রতিবছর গঙ্গাসাগর মেলা উদযাপিত হয়। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, সংক্রান্তি হল সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে স্থানান্তরের সময়কাল। হিন্দু পত্রিকা অনুযায়ী, মকর সংক্রান্তি শুরু হয় যখন সূর্যদেব মকর রাশিতে প্রবেশ করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে, সূর্যের এই স্থানান্তরের এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে কারণ মকর হল শনির ঘর এবং শনি (সূর্যদেবের পুত্র) ও সূর্য দুজনে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু মকর সংক্রান্তির সময়, সূর্য নিজের ছেলের প্রতি রাগ ভুলে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিস্তার করে। সেই কারণেই মকর সংক্রান্তির এই সময়কালকে শুভ সময় বলে চিহ্নিত করা হয়। মকর সংক্রান্তির সময় শীত ঋতুর সমাপ্তি ঘটে এবং ফসল কাটার মরসুমের সূচনা হয়। সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা এই সময় নিজেদের জমি,গবাদি পশু ও সরঞ্জামেরও বিধিবৎ পূজা করে। হিন্দু সংস্কৃতিতে এই সময়কালকে অশুভ সময়ের শেষে নতুন এক শুভ সময়ের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়।
এই সময় আবহাওয়া ক্রমে মনোরম হতে থাকে। মকর সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয় উত্তরায়ণ। এই সময় দিন ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে এবং রাত ছোট হতে থাকে। বৈদিক যুগ থেকেই সূর্যের গতিপথ চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী জ্যোতিষবিদ্যা অনুশীলন করা হয়ে আসছে যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
এই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎসব পালনের অঙ্গ হিসাবে বিভিন্ন সুস্বাদু খাদ্যও প্রস্তুত করা হয়। তিল এবং গুড় দিয়ে বিভিন্ন মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা হয়। তবে এই উদযাপন শুধুমাত্র খাদ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির একটি আবশ্যিক অঙ্গ ঘুড়ি ওড়ানো। মূলত উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি হলেও পরে এই আনন্দ উৎসব দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে।
এককথায় বলা যায়, মকর সংক্রান্তি উৎসব ও গঙ্গাসাগর মেলা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার এক অপরিহার্য অংশ যা সবাইকে ভেদাভেদ ভুলে একত্রিত করে।
স্নানের পরেই কপিল মুনি আশ্রমে পূজা:
কপিলমুনি মন্দিরে গঙ্গা দেবী, কপিলমুনি ও সাগর রাজার ভাস্কর্য বিরাজমান।
গঙ্গাসাগর তীর্থক্ষেত্রের প্রধান কেন্দ্র হল কপিল মুনির মন্দির। স্নানের আচার-অনুষ্ঠান শেষ করার পর, পুণ্যার্থীরা কপিল মুনির পূজা করেন এবং কেউ কেউ গঙ্গা স্নানের দিনে যজ্ঞ ও হোমও করেন। এমনকি কিছু ভক্ত গঙ্গা স্নানের দিনগুলিতে কঠোর উপবাস পালন করেন। সন্ধ্যায় সাগরপাড়ে পণ্ডিতদের মন্ত্রপাঠের সহিত পুণ্যার্থীদের দ্বারা দেশী ঘি দিয়ে একটি প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয় ও গঙ্গাসাগরসংগমে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। গঙ্গা স্নানের এই শুভ দিনে, ভক্তরা দেবী গঙ্গার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং জ্ঞাতসারে বা অজান্তে তাদের অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
গঙ্গাসাগর মেলা কখন এবং কোথায় অনুষ্ঠিত হয়:
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গা সাগর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৬ সালে, এই মেলাটি ১০ জানুয়ারী ২০২৬ থেকে ১৭ জানুয়ারী ২০২৬ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। তীর্থযাত্রীরা সকালে গঙ্গার পবিত্র জলে ডুব দিয়ে ভগবান সূর্যের পূজা করেন। এই কার্নিভালটি সাগর দ্বীপে অনুষ্ঠিত হয়, যা বঙ্গোপসাগরের শীর্ষে গঙ্গা ব-দ্বীপের প্রান্তে অবস্থিত। যেখানে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী, সাধু এবং যোগী মা গঙ্গা এবং বঙ্গোপসাগরের পবিত্র সঙ্গমস্থলে সমবেত হন। বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এই আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যা গঙ্গাসাগর মেলা বা গঙ্গা সাগর যাত্রা বা গঙ্গা স্নান নামে পরিচিত।
মেলা অনুষ্ঠিত করায় সরকারের বিশেষ উদ্যোগ:
২০২৬ সালে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যেই উন্নত সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে যেমন ডিজিটাল বুকিং কাউন্টার, নিরাপত্তার জন্য ড্রোন নজরদারি, পরিবেশ-বান্ধব স্যানিটেশন ইউনিট, মেডিকেল ক্যাম্প এবং ক্রমবর্ধমান দর্শনার্থীদের সমাগম নিয়ন্ত্রণে আরও ফেরি পরিষেবা। ২০২৫ সালে, ৫০ লক্ষেরও বেশি ভক্ত মেলায় এসেছিলেন; ২০২৬ সালে, সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেলা উপলক্ষে নির্মিত অস্থায়ী জেটি ও তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা:
সাগরদ্বীপে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হল মুড়ি গঙ্গা নদী। তীর্থযাত্রীদের যাত্রাপথে এই নদী অতিক্রম করতে হয়। তবে নদীর স্বল্প নাব্যতার কারণে জোয়ার ব্যতীত নদী অতিক্রম সম্ভব নয়। প্রতিবছর নদীপথে নিরবিছিন্নভাবে ফেরী পরিচালনার জন্য নদীর তলদেশ থেকে পলিমাটি খনন (ড্রেজিং) করা হয়।
মেলা ও গঙ্গাস্নান উপলক্ষে কাকদ্বীপ ও সাগরদ্বীপের কচুবেরিয়ার মধ্যে ফেরী পরিষেবা পরিচালিত হয়। বেশ কিছু অস্থায়ী জেটি নির্মাণ করা হয় দ্রুত ও অধিক তীর্থযাত্রী পরিবহনের উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলরুম থেকে সমস্ত ভেসেল ও বাসে নজরদারি চালানো যাবে। নজরদারির জন্য সাগরদ্বীপের সব পরিবহণে জিপিএস ও নেভিক (নেভিগেশন উইথ ইন্ডিয়ান কনস্টেলেশন) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। কুয়াশায় জন্য দৃশ্যমানতার সমস্যা রুখতে ভেসেলে নেভিগেশন লাইটের ব্যবস্থাও করা হবে।
মেলা উপলক্ষে প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু অস্থায়ী পরিকাঠামো নির্মাণ করা হয়। গঙ্গাসাগরসংগমে অস্থায়ী ঘাট, এবং ঘাট থেকে মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়। মেলা প্রাঙ্গণে পানীয় জলের সুবিধা ও শৌচালয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেলায় চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করে, এবং গুরুতভাবে অসুস্থ পুণ্যার্থীদের দ্রুত আকাশপথে (এয়ারলিফ্ট) কলকাতায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের জন্য মেলা প্রাঙ্গণে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি অস্থায়ী হাসপাতালও তৈরি করা হয়। সরকারের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মেলায় প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে।
সাধুসন্তরের উপস্থিতি:
হিমালয়ে বসবাসকারী সাধুসন্তরা মেলা উপস্থিত হন। তাঁরা তীব্র শীত উপেক্ষা করে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে কেবল ছাইভস্ম গায়ে মেখে অনাবৃত অবস্থায় থাকার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কীভাবে পৌঁছবেন পুন্য তিথিতে এই জায়গায়:
গঙ্গাসাগর মেলায় যোগ দেওয়ার জন্য, আপনাকে প্রথমে সাগরদ্বীপ পৌঁছাতে হবে যা কলকাতা থেকে মাত্র ১২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মেলা প্রাঙ্গণ কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে ভালভাবে সংযুক্ত। আপনি এই পথে মোটামুটি বাধাহীন ভাবেই সাগরদ্বীপে পৌঁছাতে পারেন:-
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ট্রেন হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযোগ করছে। তাই হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রচুর স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন বা এমনকি ব্যক্তিগত পরিবহন অপারেটর রয়েছে যারা আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে যদি আপনি হাওড়া স্টেশন বা আউট্রামঘাট বা কলকাতার এসপ্ল্যানেডে পৌঁছান।
বাস অথবা গাড়িতে:
কলকাতা থেকে গঙ্গাসাগরের যাত্রাপথ বেশ দীর্ঘ। প্রথমে বাবুঘাট থেকে কাকদ্বীপ যাওযার বাস ধরতে হবে, অথবা এসপ্ল্যানেড বাস টার্মিনাস থেকে কাকদ্বীপ যাওয়ার বাস পেতে পারেন। সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টা। সেখান থেকে মুড়িগঙ্গা নদী নৌকা বা লঞ্চে পেরিয়ে পৌঁছবেন কচুবেড়িয়া। কচুবেড়িযা থেকে গঙ্গাসাগরে যাওয়ার বাস বা গাড়ি পাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।ট্রেনে :
আপনি শিয়ালদহ থেকে রেলপথেও যাত্রা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ বা নামখানা পৌঁছতে হবে। তবে এই রেলপথ, দেশের বাকি অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি যে স্টেশন থেকেই যাত্রা শুরু করুন না কেন, সাগরদ্বীপ পৌঁছতে ট্যাক্সি, বাস ও নৌ-পথে যেতেই হবে।
আকাশপথ :
কলকাতার দম দমে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করুন। এর পরে, সড়কপথের জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল গঙ্গাসাগরে পৌঁছানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার হেলিকপ্টার পরিষেবাগুলি পরিচালনা করে।গঙ্গাসাগর মেলার সময় কোথায় থাকবেন
অনুষ্ঠানস্থলে রাজ্য সরকার কর্তৃক বিভিন্ন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। আপনার পায়ের বিশ্রামের জন্য কাছাকাছি কটেজ এবং হোটেল রুম রয়েছে।
কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান:
রাত্রিবেলা মেলা প্রাঙ্গন
গঙ্গাসাগর মেলায় আসা তীর্থযাত্রীরা প্রায়শই সাগরদ্বীপের কপিল মুনি মন্দিরে যাওয়ার প্রথা হিসাবে তাদের নতুন ভোরে শুরু করেন। এখানে প্রার্থনা ও পূজা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পরিচালিত হয়।
একটু আগে বুকিং যদিও আবশ্যক তবে এই স্থানগুলি ছাড়াও, আপনি মেলার মাঠ, সমুদ্র সৈকত, সাগর মেরিন পার্ক, সাগর বাতিঘর এবং বন্দর, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সুষমাদেবীচৌধুরানী মেরিন বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসডিএমবিআরআই), চিমাগুড়ি মুডফ্লাট দেখতে পারেন। এক বা দুই দিনের জন্য আপনার ছুটি বাড়াতে পারেন তবে আপনি এই জায়গার প্রাণবন্ত উচ্ছলতা অনুভব করতে পারবেন । কলকাতার কাছাকাছি দেখার জন্য অনেকগুলি ভাল জায়গা যেমন মৌসুনি দ্বীপ, বকখালি ইত্যাদি রয়েছে, আপনি সময় এবং আগ্রহের উপর নির্ভর করে আপনার ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে পারেন।
সাগর মেলা – এক কথায়
মা গঙ্গা হিন্দু ধর্মানুসারে পবিত্রতম নদী । বলা হয় যে তার কোলে একটি পবিত্র ডুব আপনার সমস্ত পাপ স্খলন করে। গঙ্গাসাগর মেল শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়। গঙ্গার জল সাথে ঠান্ডা হাওয়া বয় কিন্তু ভক্তরা তখনও নবউচ্ছাস খুঁজতে এই ঠাণ্ডা জলে ডুব দেয় – তাঁরা বিশ্বাস করেন এটি বছরের সবচেয়ে শুভ দিন। গঙ্গাসাগর মেলাকে মানব ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমজমাট মেলা হিসাবে গণ্য করা হয় (কুম্ভ মেলায় ভারতে সর্বাধিক সংখ্যক তীর্থযাত্রী থাকে বলে মনে করা হয়)।
গঙ্গাসাগর, বলা যায়, বাংলার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম এক মহাতীর্থ যার উল্লেখ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে পাওয়া যায়। প্রাচীন লোককথা অনুযায়ী, গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন রানী সত্যভামা এবং ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের বর্তমান আরাধ্য মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী রামানন্দ। এ এক মহান ঐতিহ্য, যার আলোতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগমে আজও জ্বল জ্বল করছে। আপনি গঙ্গাসাগর মেলায় প্রজ্বলিত প্রদীপ এবং জপ মন্ত্রের দৃশ্য কখনও ভুলতে পারবেন না। মনে হবে আপনার আত্মা মোক্ষ লাভ করেছে এবং আপনি পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন।


